ঢাকার বাণিজ্য আলোচনার অনুরোধ উপেক্ষা করছে দিল্লি, খেসারত দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ :

সংশোধিত :

ভারতের সঙ্গে জমে ওঠা বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একাধিকবার অনুরোধ করলেও ভারত তা উপেক্ষা করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর ফলে হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া পণ্য পরিবহন নিষেধাজ্ঞার দায়ভার বিশেষ করে বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকা বারবার অনুরোধ জানিয়েছে—স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন, এবং যৌথ কর্ম-পরিষদের সভা ডাকার জন্য। কিন্তু এসব উদ্যোগেই সাড়া মেলেনি দিল্লি থেকে।

কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত চিঠিপত্রের জবাবে ভারত নীরব অবস্থান নিয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৭ মে ভারত বাংলাদেশ থেকে প্রস্তুত পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাবারসহ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় আরও রয়েছে ফল, ফল-স্বাদযুক্ত ও কার্বনেটেড পানীয়, তুলা ও তুলার উপজাত, প্লাস্টিক ও পিভিসি পণ্য (পিগমেন্ট, ডাই বাদে), এবং কাঠের আসবাবপত্র। তবে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের একীভূত চেকপোস্টগুলো এবং পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংরাবান্ধা ও ফুলবাড়ী স্থলবন্দর দিয়ে কিছু পণ্য ঢোকার অনুমতি রয়েছে।

ভারতের এই একতরফা নিষেধাজ্ঞার পর ২৯ মে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের কাছে চিঠি লিখে এসব নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার অনুরোধ জানান। তবে প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও দিল্লি থেকে কোনো জবাব আসেনি।

উল্টো, ২৭ জুন ভারত বাংলাদেশের পাট ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানিও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে মুম্বাইয়ের দূরবর্তী নাভা শেভা বন্দর ছাড়া সব স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর দিয়ে। 

এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের পাট রপ্তানিকারকরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারা জানান, এখন প্রতিটন পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত ১০০ ডলার খরচ হচ্ছে।
এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে জাহাজে পণ্য পাঠিয়ে তা ভারতের পশ্চিম উপকূলের মহারাষ্ট্রে অবস্থিত নাভা শেভা বন্দরে পৌঁছে, সেখান থেকে আবার সড়কপথে কলকাতায় পাঠাতে হচ্ছে—যেখানে ভারতের বেশিরভাগ পাটকল অবস্থিত, এবং যা বাংলাদেশ থেকে খুব কাছেই।

এর আগেও চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ভারত বাংলাদেশি পণ্যের তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশেষ করে পোশাক রপ্তানিতে খরচ বেড়ে গেছে, কারণ ঢাকার তুলনায় দিল্লি থেকে বিমানে পণ্য পাঠানো তুলনামূলক সস্তা।

কর্মকর্তারা বলছেন, সচিব পর্যায়ের বৈঠক ও যৌথ কর্ম-পরিষদের সভার মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সর্বশেষ সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল ২০২২ সালের ৪ মার্চ, নয়াদিল্লিতে। এরপর ২০২৩ সালে ঢাকা পরবর্তী বৈঠকের আয়োজন করতে চায়। ২৪ জানুয়ারি ২০২৩-এ বাংলাদেশ ১৫ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে তিনটি সম্ভাব্য তারিখ প্রস্তাব করে, কিন্তু ভারত কোনো জবাব দেয়নি।

এরপর, সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠলে, ১২ মে ২০২৫-এ বাংলাদেশ ফের প্রস্তাব দেয় আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে সচিব পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের। কিন্তু এবারও সাড়া মেলেনি।

এমনকি ১৭ মে ২০২৫-এ ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পরপরই বাংলাদেশ অনুরোধ জানায় জুনের শেষভাগ বা জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং যৌথ কর্ম-পরিষদের সভা আয়োজনের।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সব অনুরোধই ব্যর্থ হয়েছে।

২৯ মে পাঠানো চিঠিতেও বাণিজ্য উপদেষ্টা জরুরি ভিত্তিতে সচিব পর্যায়ের বৈঠকের অনুরোধ জানান, কিন্তু ভারত তা উপেক্ষা করে।

আরেকটি অচলাবস্থার বিষয়ে কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হাটগুলো ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বন্ধ রয়েছে—সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই। যদি সচিব পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন করা যায়, তবে সীমান্ত হাটগুলো পুনরায় চালুর বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে।

এছাড়া, বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পারটনারশিপ এগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনার অগ্রগতিও ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে থমকে আছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের সরকারপ্রধানরা সিইইপিএ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছিলেন। এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশ বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করেছিল। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা বারবার চিঠি পাঠিয়েও ভারতের কাছ থেকে কোনো জবাব পাচ্ছি না।

সম্প্রতি ভারতের হাইকমিশনের একজন বাণিজ্য কূটনীতিক ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু আলোচনায় থাকা বিষয়গুলোর কোনো সমাধানের ইঙ্গিত তিনি দিতে পারেননি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তিনি দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে বলেন, ভারত কেবল বাণিজ্যিক নয়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়গুলো দেখে।

তিনি বলেন, গত বছর সরকারের পরিবর্তনের পর ভারত বলেছিল তারা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই আলোচনা করবে। আমি মনে করি, তারা এখনও সেই অবস্থান থেকে সরে আসেনি।

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে, তাই ঢাকা এখন থেকেই দিল্লিকে প্রতিনিয়ত অবহিত করতে পারে—যাতে ভবিষ্যতে আলোচনা শুরু হলে এসব বিষয় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

সর্বশেষ খবর