বাংলাদেশের সংস্কার শুরু করতে হবে নকশাগত স্তর থেকেই: লুৎফে সিদ্দিকী

প্রকাশ :
সংশোধিত :

প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সংস্কার শুরু করতে হবে মূল নকশাগত স্তর থেকে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক কাঠামোর মৌলিক ত্রুটি দূর না হলে সাম্প্রতিক কিছু সাফল্য সত্ত্বেও দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে।
রবিবার গুলশানের একটি হোটেলে দ্যা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস আয়োজিত “Business Climate: Reforms, Opportunities, and Challenges Ahead” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, টুকরো টুকরো সংস্কারে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে না; প্রয়োজন প্রশাসন ও শাসন কাঠামোর পূর্ণ পুনর্গঠন। তিনি ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন, আগামী নির্বাচিত সরকারের আমলে সংস্কারের যে সুযোগ আসবে, তা যেন হাতছাড়া না হয়, যেমনটি হয়েছিল ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর।
তিনি বলেন, “আমরা সংস্কারের জন্য একটি ঐকমত্য কমিশন গঠনের কাজ করেছিলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন হয়নি।”
“সংস্কার শুরু করতে হবে নকশাগত স্তর থেকে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে লজিস্টিকস বা রপ্তানি খাতের সার্বিক দায়িত্বে কেউ নেই।”
সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ওই দেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীনে নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়কারীরা কাজ করেন, যা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে। আমাদেরও তেমন কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রশাসনে একটি মৌলিক নকশাগত ত্রুটি রয়েছে। আমাদের লজিস্টিকস বা রপ্তানি খাতে কোনো নির্দিষ্ট জবাবদিহিতা নেই।”
লুৎফে সিদ্দিকী সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো উদ্যোগের মাধ্যমে ইতিমধ্যে পাঁচ লাখেরও বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে, এবং এতে প্রায় ১২ লাখ অফিস ভিজিট এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
তিনি জানান, বন্দরে ই-গেট চালুর ফলে পণ্য খালাসের সময় ২০ মিনিট থেকে নেমে এসেছে মাত্র ২০ সেকেন্ডে।
তবে তিনি বলেন, অটোমেশন বা ডিজিটাল রূপান্তরের প্রধান বাধা প্রযুক্তি নয়—মানসিকতা। “জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিক পরিবর্তনই সবচেয়ে জরুরি,” তিনি মন্তব্য করেন।
লুৎফে সিদ্দিকী আরও বলেন, “আমাদের আইনে প্রি-এরাইভাল কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স করার সুযোগ আছে, কিন্তু তা কার্যকর নয়। আমরা এটি চালু করার চেষ্টা করছি, যাতে বাণিজ্য সহজীকরণে বাস্তব অগ্রগতি আসে।”
সরকারে যোগদানের শুরুতে মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তখন সরকারের অর্ধেক কর্মচারী নিষ্ক্রিয় ছিলেন, নিরাপত্তার জন্য কোনো পুলিশ ছিল না, আর শিল্পাঞ্চলগুলো ছিল শ্রমিক অস্থিরতায় অস্থিতিশীল। ধীরে ধীরে প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছি।”
তিনি স্বীকার করেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের সফলতা এসেছে। এ সাফল্যের কৃতিত্ব তিনি অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেন।
“যেকোনো বড় অর্থনৈতিক ধাক্কার পর মূল্যস্ফীতি আসবেই, কিন্তু আমরা সেটি স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়েছি,” বলেন তিনি।
তিনি জানান, এখন প্রশাসনিক প্রক্রিয়াও আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। “আগে একটি অনুমোদনের জন্য পাঁচটি অফিসে যেতে হতো, এখন সমন্বয় সভার এক বৈঠকেই বিষয় নিষ্পত্তি করা সম্ভব,” বলেন লুৎফে সিদ্দিকী।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি খাতকেই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। “এসএমই খাতে এখনো শক্তিশালী কণ্ঠ নেই, তবে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি—যেমন, এসএমই কার্ড চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ৩,০০০ ডলার পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেন করতে পারবেন।”
তিনি জানান, সাম্প্রতিক প্রশাসনিক সাফল্যের মধ্যে একটি হলো—৬ লাখ অমীমাংসিত পাসপোর্ট আবেদন এক মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে, যা কার্যকর সমন্বয়ের ফল।
আলোচনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন এবং এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর (ইপিবি) উপ-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ আলোচনায় বলেন, “বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ম্যান্ডেট অপরিহার্য।”
তিনি আরও যোগ করেন, “জ্বালানি নিরাপত্তা এখনো একটি উদ্বেগের বিষয়। খাতটিতে অগ্রগতি হলেও কিছু নীতিগত ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।”
গোলটেবিল বৈঠকে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও ভবিষ্যৎ সংস্কার কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।


For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.