স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও সড়কে বিশৃঙ্খলা: আমরা কি সত্যিই সভ্য জাতি?

ফাইল ছবি।
ফাইল ছবি।

প্রকাশ :

সংশোধিত :

স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের সড়ক এখনো মৃত্যুকূপের নামান্তর। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবার হারাচ্ছে প্রিয়জনকে বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও দুর্বল আইন প্রয়োগের কারণে। সড়ক যেন আজ উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিফলন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির (বিজেকেএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে ৬৭,৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১,১৬,৭২৬ জন নিহত এবং ১,৬৫,০২১ জন আহত হয়েছেন। সংগঠনটির মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ হাসপাতাল ও গণমাধ্যমের তথ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

দুর্নীতি ও ভুলনীতি দায়ী

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “দুর্নীতি ও সরকারের ভুল নীতিই সড়কে গণহত্যার জন্য দায়ী।”

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার আগে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে চলাচল করত, আর সড়কে যাতায়াত করত মাত্র ২০ শতাংশ। কিন্তু স্বাধীনতার পর দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশনে সড়ক উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগেই ছিল দুর্নীতি ও লুটপাট। ফলে এখন যাত্রী চাহিদার ৮০ শতাংশই সড়কে কেন্দ্রীভূত, আর দুর্ঘটনাও বেড়েছে একই অনুপাতে।”

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও যত মানুষ নিহত হয়নি, বাংলাদেশের সড়কে নিহতের সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়।”

আইন প্রয়োগে শিথিলতা ও জবাবদিহির অভাব

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু চালকের বেপরোয়া আচরণ নয়, বরং প্রশাসনিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও জবাবদিহির অভাবের ফল। দেশের সড়কে এখনো লক্ষাধিক ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করছে, যার অধিকাংশের চালক লাইসেন্সবিহীন বা অপ্রাপ্তবয়স্ক।

একজন সাবেক বিআরটিএ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রুট পারমিট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স—সব জায়গায় ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব আছে। ফলে আইনের প্রয়োগ বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে না।”

বিআরটিএর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ লাখেরও বেশি যানবাহন ফিটনেস নবায়ন ছাড়াই চলছে, যার বড় অংশই নিয়মিত দুর্ঘটনায় জড়িত। তবু এই অনিয়ম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা খুব কমই দেখা যায়।

বারো দফা প্রস্তাবনা

যাত্রী কল্যাণ সমিতি তাদের ১২ দফা প্রস্তাবে বলেছে,

  • যাত্রী কল্যাণ সমিতি তাদের ১২ দফা প্রস্তাবে বলেছে:
  • সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয়ে একীভূত যাতায়াত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে,
  • পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে,
  • বিভাগীয় শহরে ম্যাস ট্রানজিট ও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালু করতে হবে,
  • মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত যানবাহনের আমদানি সীমিত করতে হবে,
  • পেশাদার ড্রাইভিং একাডেমি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে,
  • ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করতে হবে এবং
  • সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের জন্য নিরাপদ লেন তৈরি করতে হবে।

তাদের মতে, সড়ক নিরাপত্তা এখন জাতীয় সংকট—এটি কেবল মন্ত্রণালয়িক বিষয় নয়, বরং জীবনরক্ষার প্রশ্ন।

বিআরএসএন-এর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দাবি

একইদিনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত আরেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্ক (বিআরএসএন) সড়ক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কারের দাবি জানায়।

বিআরএসএন-এর সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে — রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান), ইভেন্টফুল বাংলাদেশ সোসাইটি, নুসরাত জাহান তোমা ফাউন্ডেশন, সেবা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, থটস অ্যান্ড থ্রু, এবং সেন্টার ফর ওয়ার্ক অ্যান্ড অকুপেশনাল হেলথ সেফটি।

তারা ‘রোড ম্যানেজমেন্ট রিফর্ম কমিশন’ গঠনের দাবি জানায়, যাতে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদ, ট্রাফিক আইনজীবী ও পরিবেশবিদরা একসঙ্গে কাজ করে নতুন সড়ক নিরাপত্তা নীতি তৈরি করতে পারেন।

তাদের প্রস্তাবে আরও বলা হয়—জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করতে হবে, বিআরটিএ ও বিআরটিসির শীর্ষ পদে রাজনৈতিক নয়, টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে এবং গণপরিবহনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

একজন সংগঠক বলেন, “যতদিন পরিবহন খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না।”

প্রতিদিনের মানবিক ট্র্যাজেডি

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার ভোর। রাজধানীর হাতিরঝিলের নীরব রাস্তায় ৬৭ বছর বয়সী রিকশাচালক আউয়াল তার পুরোনো রিকশাটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন—যেমন প্রতিদিন চালান জীবিকার তাগিদে। কিন্তু সেদিন তার জীবন থেমে যায় এক বেপরোয়া প্রাইভেট কারের চাকায়। রেড ক্রিসেন্টের কাছে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় পথচারীরা ছুটে আসে, আহত আউয়ালকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গরোমি গ্রামের আবদুল আজিজের ছেলে আউয়ালের এই মৃত্যু হয়তো সংবাদপত্রে কয়েক লাইনের খবর; কিন্তু বাস্তবে এটি শহরের এক নীরব সত্য—যেখানে দরিদ্র রিকশাচালক, দিনমজুর আর ফুটপাতের মানুষ প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় অব্যবস্থাপনা, অবহেলা আর বৈষম্যের মাঝে। ঢাকার সড়কে প্রতিটি ‘দুর্ঘটনা’ আসলে একটি অঘোষিত সামাজিক অন্যায়ের গল্প।

নিয়ম মানার সংস্কৃতি নেই

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, “আমরা নিয়ম মানতে জানি না, কিংবা জানলেও মানতে চাই না। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, ফুটওভারব্রিজ এড়িয়ে রাস্তা পার হওয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো কিংবা উল্টো পথে গাড়ি চালানো—সবকিছুই এখন আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।”

তারা আরও বলেন, “এটি শুধু নীতিগত বা আইনি সমস্যা নয়, এটি গভীর আচরণগত সংকট। নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলাবোধ তৈরি না হলে কোনো আইন, কোনো অভিযান বা কঠোর শাস্তিই স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারবে না। মানুষকে বুঝতে হবে, নিয়ম মানা মানে শুধু আইন মানা নয়—এটি নিজের এবং অন্যের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা সৃষ্টি, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ট্রাফিক শিক্ষা, গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার এবং নাগরিকদের নিজস্ব মানসিক পরিবর্তন। “আমরা যদি নিজের আচরণ না বদলাই, তাহলে যত আইনই করা হোক না কেন, সড়কে অরাজকতা থামবে না,” বলেন তারা।

আশার আলো

তবে আশার দিকও আছে। ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ সারাদেশে আলোচনার ঝড় তোলে এবং সরকারকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করতে বাধ্য করে। যদিও সেই গতিশীলতা এখন ক্ষীণ, তবে তরুণ প্রজন্মের সচেতনতা নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

শেষ কথা

একটি দেশের উন্নয়ন কেবল ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেলে নয়, বোঝা যায় তার সড়কে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। সড়কে বিশৃঙ্খলা মানে শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের নাগরিক সভ্যতারও পরিমাপক।

যেদিন আমরা বুঝব—সড়কের নিরাপত্তা মানে মানবিকতা, দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলার প্রতীক—সেদিনই হয়তো আমরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারব।

সর্বশেষ খবর