সরকারি ক্রয়ে নতুন কৌশল নিয়ে ভাবনা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
রিপোর্ট

প্রকাশ :

সংশোধিত :

সরকারি ক্রয়ের নিলাম প্রক্রিয়াকে আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে সরকার ১০ শতাংশ বিডিং ক্যাপ পদ্ধতি বাতিলের পরিকল্পনা করছে। এই পদ্ধতিতে কোনো দরপত্র উদ্ধৃত মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি বা কম হয়ে থাকে তা বাতিল বলে  গণ্য হয়। এই পদ্ধতিটি দুর্নীতির একটা বড় সুযোগ তৈরি করে। কেননা এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে নিলামের দর  ঠিক করে, যে সেটা উদ্ধৃত  মূল্যের ১০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম হয়। এটা অনেকাংশেই সন্দেহজনক ও সম্ভাব্য উপাত্ত কারসাজির ইঙ্গিত দেয়। দরপত্রের প্রাক্কলিত মূল্য একটি গোপনীয় তথ্য, কিন্তু অনেক কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে তা প্রকাশ করে এবং এর মাধ্যমে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। যখন কোনো সরকারি ক্রয়ের জন্য একাধিক ঠিকাদার একই দর উল্লেখ করে দেয়, তখন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগে ৩০০ মেট্রিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়; যা সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই সু্যোগ দেয় যারা আগেও কাজ পেয়েছে। মূলত,  এই ধরনের নিলাম পদ্ধতি নতুন ঠিকাদারদের তেমন সুযোগ দেয় না; বরং কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানই একাধিক কাজ পেয়ে থাকে।  ১০ শতাংশ বিডিং ক্যাপ বাতিলের পরিকল্পনা সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়াকে আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক করবে। 

অবশ্য ১০ শতাংশ বিডিং ক্যাপ বাতিলের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজসে অস্বাভাবিক নিম্নমূল্যে প্রস্তাবেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ পাবলিক প্রোকিউরমেনন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) ইতিমধ্যে অস্বাভাবিক নিম্নমূল্য প্রস্তাবনার শঙ্কার বিপরীতে কারগরি কমিটি গঠন করেছে, যারা কৌশলগতভাবে এটি প্রতিরোধ করবে। কেননা এটি কাজের মানকে নিম্নমুখী করবে। এ সমস্যা মোকাবিলায় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে ঠিকা প্রদানের যে প্রচলিত পদ্ধতি আছে, তা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে কিংবা কেবলমাত্র প্রতিযোগিতামূলক নিলাম ডাকা প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে বিপিপিএ কোরিয়ান পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারা। কোরিয়ান পদ্ধতিতে সকল ঠিকাদারের প্রস্তাবিত ডাক মূল্যকে গড় করা হয় এবং সেই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয় যাদের দরপত্র পরিমাপকৃত গড়ের কাছাকাছি থাকে। দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবিত নিম্নমূল্য ও অধিকমূল্যকে প্রতিহত করতে এটা একটা কার্যকরী উপায়।

যাইহোক, সরবাহ চেইনের প্রতিটি পর্যায়ে কৌশলগত পুনর্গঠন ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রায়শই দুর্নীতি শুরু হয় পক্ষপাতদুষ্ট ক্রয় বিবরণী থেকে, যা নির্দিষ্ট কিছু সরবাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেয়। দরপত্রের পক্ষপাতমূলক শর্তাবলী ও অস্পষ্ট ক্রয় বিবরণী প্রায়ই সুষ্ঠু নিলাম প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে। এজন্য  টেন্ডারের শর্তাবলী প্রণয়ন ও মূল্যায়ন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে করা উচিত। যাইহোক, শুধুমাত্র দরপত্র প্রক্রিয়ার সংস্কারই যথেষ্ট নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে কঠোর তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে, যা জবাবদিহিতা ও কাজের মান ধরে রাখতে সহায়ক। 

আমাদের দেশের সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া দীর্ঘদীন ধরে প্রচণ্ড দুর্নীতির ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিল। যেখানে দরপত্র আইনের লঙ্ঘন হতো, ক্ষমতার অপব্যবহার হতো, রাজনৈতিক প্রভাব ঘাটানো হতো, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম ছিল, দরপত্রের গোপনীয়তা নীতির ভঙ্গ হতো এবং টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হতো না।

যখন সরকারি ক্রয়ে দরপত্রের ডিজিটাল সিস্টেম ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় তখন মনে করা হয়েছিল দরপত্র প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়গুলো অনেকাংশে কমে আসবে। কিন্তু ২০২৩ সালে টিআইবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরদাতা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকতাদের মধ্যে যোগসাজসে ই-জিপি সিস্টমে কাজের চুক্তি পূর্বেই নির্ধারিত হয়। সকল ধরনের সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য এগুলো যাতে ই-জিপি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যাইহোক, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তখনই নিশ্চিত হবে যখন দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ঠিকার দাতা-গ্রহীতারা নৈতিকভাবে সৎ হবে। নতুবা, সরকারি ক্রয়ের দুর্নীতি চলতেই থাকবে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিঃশেষ করবে।

সর্বশেষ খবর