প্রবৃদ্ধির গতি কমছে, এখনই সময় সাহসী সংস্কারের

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

প্রকাশ :

সংশোধিত :

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক মূল্যায়ন আশাবাদ ও সতর্কবার্তার মিশেল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)—সবাই বলছে, প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে। মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, কর আদায়ের সীমাবদ্ধতা ও বৈদেশিক অনিশ্চয়তা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

আইএমএফের সতর্ক সংকেত
আইএমএফ তাদের অক্টোবরের World Economic Outlook–এ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৪.৯ শতাংশ করেছে, যা গত জুনে ছিল ৫.৪ শতাংশ। সংস্থাটির এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক কৃষ্ণ শ্রীনিবাসন জানান, প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে তিনটি কারণ প্রধান—কঠোর নীতিমালা, শুল্কনীতির প্রভাব এবং সামগ্রিক অনিশ্চয়তা।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং ঋণপ্রবাহের সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আইএমএফের হিসাবে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াতে পারে ৮.৭ শতাংশে।

আইএমএফ মনে করে, রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং ব্যাংক খাতের সংস্কার এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। তাদের মতে, এসব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম এখনো কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোয়নি।

বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ: পুনরুদ্ধার হলেও ঝুঁকি রয়ে গেছে
বিশ্বব্যাংক তাদের Bangladesh Development Update–এ জানিয়েছে, চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৪.৮ শতাংশ, যা আগের বছরের ৪ শতাংশ থেকে কিছুটা বেশি। আগামী অর্থবছরে (২০২৬–২৭) প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে ৬.৩ শতাংশে।

সংস্থাটি বলেছে, বছরটির প্রথমার্ধে নানা বিপর্যয় থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে—রপ্তানি আয় বেড়েছে, রেমিট্যান্স রেকর্ড করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উন্নতি হয়েছে। তবে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে, কর আদায় দুর্বল, ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধের চাপও বেড়েছে। দারিদ্র্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে—তিন মিলিয়ন নতুন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ২.৪ মিলিয়ন নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারেননি।

বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা জ্যঁ পেসমে বলেন, “অর্থনীতি স্থিতিশীলতা দেখাচ্ছে, কিন্তু এটি স্থায়ী নয়। রাজস্ব সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা নিরসন, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন—এসব সংস্কার এখন জরুরি।”

এডিবির আশঙ্কা: বৈশ্বিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের Asian Development Outlook–এ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, নির্বাচনের আগে ভোগব্যয় (consumption) প্রবৃদ্ধির মূল চালক হবে, তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এডিবি বিশেষভাবে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়ে, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশের ওপর প্রভাব ফেলবে। এতে তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নারী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন।

এছাড়া, ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা দাম কমাতে বাধ্য হতে পারেন—যদি না তারা দ্রুত বাজার বৈচিত্র্য ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা বাড়ায়।

এডিবি আরও বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারি ব্যয় ও বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়তে পারে, যা মূল্যস্ফীতিকে উচ্চ রাখবে। তাদের হিসাবে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে।

কী করতে হবে এখন?
তিন সংস্থার প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ একটাই—বাংলাদেশ এখন এক মোড় ঘুরানোর জায়গায় দাঁড়িয়ে। প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে হলে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে তিনটি দিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:

১. রাজস্ব সংস্কার: কর আদায় জিডিপির অনুপাতে বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি রোধে প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা জরুরি।
২. ব্যাংক খাত সংস্কার: অনাদায়ী ঋণ কমানো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়ানো ও সুশাসন জোরদার করা।
৩. রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৈচিত্র্য: পোশাকের বাইরে আইটি, সিরামিক, ওষুধ ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নীতি সহায়তা বাড়ানো।

এর পাশাপাশি, নারী শ্রমশক্তিকে অর্থনীতির মূলধারায় আনা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নও এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো টিকে আছে দৃঢ়তায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে—সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও সঠিক নীতিনির্ধারণের ওপর। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি—সবাই বলছে একই কথা: সময় এখন বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। 

sajibur@gmail.com 

সর্বশেষ খবর