চীনের ২০২৫ সালের ‘দুই অধিবেশন’: আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে যে বিষয়গুলো

প্রকাশ :

সংশোধিত :

জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক পরিবেশের পটভূমিতে বেইজিংয়ে চীনের জাতীয় ‘দুই অধিবেশন’ শুরু হয়েছে। দেশের নীতি-নির্দেশনা প্রণয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যক্রম এই ‘দুই অধিবেশন’।

চীনের শীর্ষ পরামর্শসভা, গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের (সিপিপিসিসি) জাতীয় কমিটির বার্ষিক অধিবেশন বসেছে মঙ্গলবার। আর শীর্ষ আইনসভা, জাতীয় গণকংগ্রেসের (এনপিসি) অধিবেশন শুরু হয়েছে বুধবার।

চীনের প্রধানমন্ত্রী, শীর্ষ আইন-প্রণেতা, শীর্ষ রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং শীর্ষ প্রকিউরেটর নিজ নিজ সংস্থার কর্ম প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন অধিবেশনে। আইন-প্রণেতারা সরকারের বার্ষিক বাজেট এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা পর্যালোচনা করবেন। তারা এনপিসি এবং স্থানীয় গণকংগ্রেসের ডেপুটি সংশ্লিষ্ট একটি আইন সংশোধনের বিষয়ে আলোচনা করবেন।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে, বিভিন্ন সরকারি বিভাগের মন্ত্রীরা সাক্ষাৎকার এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের সাথে যোগাযোগ করবেন, নীতিমালা স্পষ্ট করবেন এবং জরুরি উদ্বেগের জবাব দেবেন।

 ‘দুই অধিবেশন’ আগামী বছরের জন্য চীনের উন্নয়ন পরিকল্পনা পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ জানালা হিসেবে কাজ করবে। এখানে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং নীতি-ঘোষণাগুলো কেবল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন চীনা নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করবে না বরং দেশের সীমানার বাইরেও এটি প্রভাব ফেলবে।

তাহলে, এই বছরের ‘দুটি অধিবেশন’ থেকে কী আশা করা যেতে পারে?

২০২৫ সালের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য

সাধারণত, সরকারি কর্ম-প্রতিবেদনে নির্ধারিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সবচেয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা পরিসংখ্যানগুলোর মধ্যে একটি। চীনের অর্থনীতি উচ্চমানের উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদিও জিডিপি অর্থনীতির একমাত্র পরিমাপক নয়, তবুও এটি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

২০২৪ সালে, চীন প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এটি মূলত সম্ভব হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার চাপ কমাতে প্রবর্তিত উল্লেখযোগ্য সিরিজ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপের কারণে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি গভীর এবং বিস্তৃত তাৎপর্যসহ অর্থনীতিতে একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তা সত্ত্বেও, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান চীনের, যা এটিকে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির বৃহত্তম উৎস করে তুলবে।

ক্রমবর্ধমান নীতিগত পদক্ষেপ

প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপিত করার জন্য চীন আরও লক্ষ্য-ভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করবে। সরকারি কর্ম প্রতিবেদনে লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার জন্য দুই অধিবেশনে নীতিগত পদক্ষেপ ঘোষণা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে ।

চীন ইতিমধ্যেই তার সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক কর্ম সম্মেলনে, নীতিনির্ধারকরা ২০২৫ সালে আরও সক্রিয় সামষ্টিক নীতি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, তারা একটি ‘মাঝারিভাবে শিথিল’ মুদ্রানীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা গত ১৪ বছর ধরে ‘বিচক্ষণ’ পদ্ধতি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে সরে আসাকে চিহ্নিত করে।

সভায় নয়টি মূল অগ্রাধিকারের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ভোগ বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এটি অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর চীনের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার হিসাবে জোর দেওয়ার প্রতিফলন ঘটায়। ২০২৫ সালে, বৃহৎ আকারের সরঞ্জাম আপগ্রেড এবং ভোগ্যপণ্য বাণিজ্য কর্মসূচি আরও তীব্রতার সাথে এবং বিস্তৃত পরিসরে প্রচার করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী ল্যান ফো'আনের মতে, ২০২৫ সালে চীন সক্রিয়ভাবে উচ্চ-ঘাটতির সুযোগ ব্যবহার করবে, স্থানীয় সরকারের বিশেষ-উদ্দেশ্য বন্ড জারি করবে, অতি-দীর্ঘ বিশেষ ট্রেজারি বন্ড জারি করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্থানীয় সরকারগুলোতে অর্থ স্থানান্তর বৃদ্ধি করবে। এই পরিকল্পনাগুলোর সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো এ বছরের ‘দুই অধিবেশন’র একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে।

নেতা, আইন-প্রণেতা, উপদেষ্টাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া

‘দুই অধিবেশন’ চলাকালীন, চীনা নেতারা, যারা নিজেরাই এনপিসি ডেপুটি, তাঁরা তাদের সহকর্মী আইন প্রণেতাদের সাথে গ্রুপ আলোচনায় মতবিনিময় করবেন। তারা রাষ্ট্রীয় শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সাথেও মতবিনিময় করবেন।

এই মিথস্ক্রিয়াগুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূলের বাস্তবতা সম্পর্কে কীভাবে অবগত থাকে তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি জানালা হিসেবে কাজ করে। এটি চীনা গণতন্ত্রের একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য, যা প্রায়শই সমসাময়িক আলোচনায় সম্পূর্ণ-প্রক্রিয়া জনগণের গণতন্ত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ১৪তম এনপিসিতে চিয়াংসু প্রদেশের প্রতিনিধিদলের একজন ডেপুটি হিসেবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সাধারণত প্রতিনিধিদলের আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিং, সশস্ত্র বাহিনীর এনপিসি প্রতিনিধিদলের বৈঠকেও যোগ দেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের গ্রুপ আলোচনায় অংশ নেন।

এই মিথস্ক্রিয়াগুলোর সময়, সি বেসরকারি খাত এবং বেসরকারি উদ্যোগের বৃদ্ধিকে সমর্থন করা, ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং উচ্চ-স্তরের উন্মুক্তকরণকে এগিয়ে নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের উপর জোর দেন- যা চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বিদেশ-নীতি

‘দুই অধিবেশন’ চীনের পররাষ্ট্রনীতির উপরও আলোকপাত করে, কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাধারণত বৈঠকের ফাঁকে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।

গত বছর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ৯০ মিনিটের এক সংবাদ সম্মেলনে ২১টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, যেখানে সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেন, যেমন ইউক্রেন সংকট এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েলি সংঘাত। তিনি রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর প্রতি চীনের বৈদেশিক নীতিও ব্যাখ্যা করেন।

এ বছরের ‘দুই অধিবেশনে’, দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং অস্থির বৈশ্বিক দৃশ্যপটের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর চীনের প্রস্তাবগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এআই, উদ্ভাবন মূল ফোকাস

নিঃসন্দেহে, এই বছরের ‘দুই অধিবেশনে’ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন একটি মূল ফোকাস হবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শিল্প কেন্দ্রবিন্দুতে আসার সম্ভাবনা খুব বেশি।

গত মাসে, চীনা প্রযুক্তি স্টার্ট-আপ ডিপসিক একটি ওপেন-সোর্স এবং জনপ্রিয় চ্যাটবট চালু করে বিশ্বব্যাপী এআই শিল্প এবং মূলধন বাজারে চমক পাঠিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে, টেনসেন্ট, বাইদু এবং বিওয়াইডির মতো কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যে ডিপসিককে একীভূত করা শুরু করেছে। কিছু স্থানীয় সরকার জনসেবা বৃদ্ধির জন্য ডিপসিক এআই মডেলের সাথে সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে, অন্যদিকে অন্যরা কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িক পেশাদারদের ডিপসিক এবং অন্যান্য এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং প্রয়োগ আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করার জন্য প্রশিক্ষণ অধিবেশন আয়োজন করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, এআই ইতিমধ্যেই এই বছরের প্রাদেশিক-স্তরের ‘দুই অধিবেশনে’র অনেকগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের কাজের প্রতিবেদনে উল্লিখিত অনেক এআই-সম্পর্কিত পরিকল্পনা উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম তৈরি, গভীর শিল্প সংহতকরণ প্রচার এবং নীতি কাঠামো উন্নত করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

এটি লক্ষণীয় যে ডিপসিকের মতো উদ্ভাবনের উত্থান প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতি চীনের প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিভা লালন, উদ্ভাবন-বান্ধব পরিবেশ, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের লালন-পালনের উপর এর বিস্তৃত কৌশলগত মনোযোগ প্রতিফলিত করে। ‘দুই অধিবেশন’ চলাকালীন এই উপাদানগুলো জোরদার করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অতিরিক্তভাবে, অধিবেশনগুলো আইন প্রণেতা এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের জন্য পরামর্শ দেওয়ার এবং জাতীয় উন্নয়নের উপর বিস্তৃত ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। তাদের মধ্যে কিছু কর্পোরেট নির্বাহী এবং নেতৃস্থানীয় গবেষক। তারা এআই-সম্পর্কিত কী প্রস্তাব এবং পরামর্শ উপস্থাপন করবেন তা চীন পর্যবেক্ষকদের জন্য একটি প্রধান আগ্রহের বিষয় হবে।

  • সিনহুয়া থেকে ভাষান্তর করেছেন মাহমুদ হাশিম। তিনি সিএমজি বাংলা, বেইজিংয়ে কর্মরত একজন বিদেশি ভাষা বিশেষজ্ঞ
সর্বশেষ খবর