বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও এফবিসিসিআই’র আসন্ন নির্বাচন

প্রকাশ :
সংশোধিত :

বিগত ১৫ বছরে তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মত এফবিসিসিআই’র নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। বাণিজ্য সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রণীত বাণিজ্য সংগঠন বিধি-১৯৯৪ এবং বাণিজ্য সংগঠন আইন-২০২২-কে শাসকগোষ্ঠীর দোসররা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছেমত কাটাছেড়া করে পছন্দের প্রার্থীদের সিলেকশন করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতেন। সাধারণ ভোটারদের ভোট দিয়ে সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন করার অধিকার ছিল না।
ছাত্র-জনতার মনসুন রেভালুশন বা বর্ষা বিপ্লবের পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দীর্ঘ দিনের বঞ্চিত ও বৈষম্যের স্বীকার ব্যবসায়ীরা ফেডারেশন ভবনের সামনে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন,যার কারণে সরকার বিগত পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে।
বৈষম্য-বিরোধী সংস্কার পরিষদ-এফবিসিসিআই-এর আহবায়ক জাকির হোসেন নয়ন, সদস্য সচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন এবং উপদেষ্টা গিয়াসউদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে শুরু হয় আরেক আন্দোলন - এফবিসিসিআই সংস্কার আন্দোলন। সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি পদক্ষেপে অগণিত বাধার সন্মুখীন হতে হয়। বৈষম্য-বিরোধী সংস্কার পরিষদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৬টি প্রস্তাব পেশ করে এবং বেশিরভাগ প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বাণিজ্য সংগঠন বিধি-২০২৫-এ সদস্যদের বার্ষিক চাঁদার হার বৃদ্ধি, ডকুমেন্ট ভেরিফিকেন কোড বা ডিভিসিসহ নিরীক্ষা প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করার কারণে ব্যবসায়ীরা সংক্ষুব্ধ হন। সব প্যানেল প্রধানের দাবির প্রেক্ষিতে ডিভিসিসহ কাগজপত্র জমাদানের সময় বৃদ্ধি করা হয়। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জনবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাইকোর্টে ৬টি রিট আবেদন দায়ের করেন। হাইকোর্ট থেকে রিট আবেদন মীমাংসার পর গত ২১ আগস্ট বিকালে নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। ফেডারেশনের সাধারণ সদস্যরা অধীর আগ্রহে ভোট উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছেন। কেননা গত ১৫ বছরে সদস্যরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশের সব প্রতিষ্ঠানে ভেঙে পড়া নির্বাচনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের উপর গুরুত্বারোপ করছেন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ-ডাকসুসহ ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এফবিসিসিআই দেশের সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি এবং প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা পাচারের কারণে অনেকগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। সুদের হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের এত উচ্চ সুদ দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার সুফলও ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর জুলাইয়ে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ সেখানে এ বছর জুলাইয়ে সেটা নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছর জুলাইয়ে ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এ বছর জুলাইয়ে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে। সর্বোপরি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিভিন্ন দেশে পাল্টা ট্যারিফ আরোপের ফলে বৈশ্বিক ব্যবসায়ী শৃঙ্খলা নতুন রূপ ধারণ করবে। এটা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বয়ে আনবে। সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারবো কিনা সেটা নির্ভর করবে আমাদের নতুন নেতৃত্বের দক্ষতার উপর।
এছাড়া ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হতে যাচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গত এক বছরে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতি ও বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনের চিন্তা গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তৎকালীন সরকার করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন করলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় গ্র্যাজুয়েশন বিলম্ব করাই যৌক্তিক বলে ধারণা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের মতো দেশগুলো ট্যারিফ আরোপ করবে। যেসব দেশের সঙ্গে এখন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে, সেখানে সুবিধাগুলো আর পাবে না বাংলাদেশ। কারণ তখন এ দেশকেও গ্র্যাজুয়েট হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে।
এ অবস্থায় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গ্র্যাজুয়েশনের সময় বিলম্বিত করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ চাইলে এখানে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট পলিসি কমিটির মূল্যায়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অনুমোদন এবং সাধারণ পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়ে সময় চাইতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের গ্র্যাজুয়েশন বিলম্বিত করেছে।
এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় এনে এফবিসিসিআই নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে বাধাপ্রদানকারী অপশক্তিকে প্রতিহত করা জরুরি। কেননা একটা পক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বিগত স্বৈরাচারীদের ফেরার পথ মসৃণ করতে চায়, গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ এফবিসিসিসআই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই নির্বাচন বোর্ড ও আপীল বোর্ড পুনর্গঠন করার জন্য। দেশ এখন নির্বাচনের মহাসড়কে। আশা করি, নির্বাচন বোর্ড শিগগির এফবিসিসিআই নির্বাচনের তফসিল আবার প্রকাশ করে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশের সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
- আতিকুর রহমান বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক

