আমেরিকার মন্দায় কেমন হবে বাংলাদেশের রপ্তানি?

প্রকাশ :

সংশোধিত :

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক ঝড়ে এখন কাঁপছে সারাবিশ্ব। অতিসম্প্রতি তিনি আমেরিকার রপ্তানি বাজারে প্রবেশের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন। 

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল ৩৭ শতাংশ। এই ঘোষণায় তোলপাড় শুরু হয় সারাবিশ্ব জুড়ে। কারণ, বাংলাদেশের মত বিশ্বেও অনেক দেশের জন্য আমেরিকা এক বিরাট রপ্তানি বাজার।

তাই অতিরিক্ত শুল্কভারে পড়া সকল দেশের সরকার এবং ব্যবসায়িক সমাজে আলোচনা চলতে থাকে এই অতিরিক্ত শুল্ক কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারও আঁটঘাট বেঁধে নামে। এর ফলে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লেখেন। সেখানে প্রসঙ্গিক বিষয়ের সাথে এই অনুরোধও করা হয় যে ট্রাম্প যেন তিনমাসের জন্য এই শুল্কারোপ স্থগিত করেন।

এই ধরনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে নমনীয় হন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চীন বাদে বাকী দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক যা পাল্টা শুল্ক  (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। তবে সবার জন্য সার্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রেখেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে শুল্ক আক্রান্ত সকল দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ী সমাজ কিছুটা হলেও এখন স্বস্তি পাচ্ছেন।

পরিস্থিতি যাই হোক, আমাদেরকে কিন্তু এখন পর্যালোচনা করতে হবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের রপ্তানির ওপর এই শুল্ক যদি আবারও ধার্য করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে।

এখন সারা বিশ্বে আলোচনা চলছে, এই অতিরিক্ত শুল্ক আমেরিকাতে মন্দা ডেকে আনবে কি না, এবং মন্দা যদি সত্যিই আসে, তাহলে সারা বিশ্বেও রপ্তানি পরিস্থিতি কেমন হতে পারে।

আমরা এখন আলোচনা করব আগামীতে আমেরিকায় মন্দা আসলে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বা গার্মেন্টস রপ্তানির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব কেমন হতে পারে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ আমেরিকার বস্ত্র (টেক্সটাইল) এবং তৈরি পোশাক (এপারেল) পণ্যের বাজারে কোন কোন উপখাতে প্রতিযোগিতা করছে, তা জানতে হলে আমাদেরকে প্রতিটি দেশের গড় পণ্য মূল্য তুলনা করতে হবে। ছবিতে দেখানো চার্ট অনুযায়ী বিগত চার বছরে আমেরিকার গার্মেন্টস পণ্যের বাজারে বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের প্রতি একক গড় মূল্য (ইউনিট প্রাইস) কেমন ছিল।

চার্টে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ যে সকল গার্মেন্টস পণ্য আমেরিকাতে রপ্তানি করে, তাদের গড় মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। অর্থাৎ বাংলাদেশ মূলত কম দামি পণ্যগুলি আমেরিকায় রপ্তানি করে থাকে।

এখানে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, চীনের ক্ষেত্রে এই গড় মূল্য বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের চেয়েও কম। চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উন্নত, এবং তারা সাধারণত আরও উন্নত স্তরের বা দামী পোশাকের বাজারের জন্য পণ্য সরবরাহ করে।

কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে উলটো চিত্র। এখানে বলা দরকার, বিগত চার বছরে চীন আমেরিকার টেক্সটাইল এবং এপারেল পণ্যের বাজারে হিস্যা হারিয়েছে প্রায় চার শতাংশ যা অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ দখল করেছে। বাংলাদেশের হিস্যা এই সময়ে বেড়েছে এক শতাংশ। তাই এটা হতে পারে, বিগত চার বছরে বাজার হারানোর ফলে চীন এখন আমেরিকার বাজারে পণ্য ডাম্পিং করছে। চীনে প্রস্তুতকৃত পণ্যের গড় মূল্য এতো কম কেন, তা নিয়ে আরো গবেষণা করা উচিত।

বিগত দশকগুলিতে আমেরিকার মন্দাকালীন সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানির চিত্র কেমন ছিল, তা বোঝার জন্য আমরা নীচের সারণির তথ্য-উপাত্ত দেখব।

২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকায় মন্দা এসেছে তিনবার । প্রথম মন্দা এসেছিল ২০০০-২০০২ সময়কালে, তারপর ২০০৭-২০০৯ সময়কালে, এবং সর্বশেষ মন্দা এসেছিল কোভিডের সময় ২০১৯-২০২১ সময়কালে। 

আমেরিকার এসব মন্দাকালীন সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানির চিত্র তুলে ধরতে তৈরি সারণির তথ্য-উপাত্ত উল্লেখিত উপাত্ত অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণে ওঠানামা লক্ষ্য করা যায়। ২০০০ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০০২ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কমে ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়নে পৌঁছায় এবং এ সময় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। পরবর্তী কয়েক বছরে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৮ সালে ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়নে উন্নীত হয়, যেখানে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। তবে ২০০৯ সালে আবারও সামান্য পতন ঘটে। এরপর ২০১৯ সালে রপ্তানি ৫ দশমিক ৯২ বিলিয়নে পৌঁছে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়, যদিও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবের কারণে রপ্তানিতে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ হ্রাস ঘটে। তবে ২০২১ সালে দৃশ্যপট পাল্টে যায় এবং রপ্তানিতে ৩৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটে, যা এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ।
 
এই তিন সময়কালে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখাতে তৈরি সারণিতে দেখা যায়, ২০০০-২০০২ সময়কালে আমেরিকায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেশ কমে গিয়েছিল। এখানে বলা দরকার এই সময়কালে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের মত।

কিন্তু বিপরীতচিত্র দেখা যাচ্ছে ২০০৭-২০০৯ সময়কালে। এই সময়কালে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি অনেক বেড়েছিল। ২০০৮ সালে যখন আমেরিকার বাজার পুরো মন্দাকালীন সময় পার করছে, তখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

কিন্তু ২০১৯-২০২১ কোভিড সময়কালে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তখন মানে ২০২০ সালে রপ্তানি কমে গিয়েছিল। এর মূল কারণ আমেরিকার বাজারে মন্দার সাথে সাথে বাংলাদেশও তখন কোভিডকালীন সময় পার করছিল। সেসময় অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ ছিল লকডাউনের কারণে। তবে ২০২১ সালে এসে এই রপ্তানি পতন থেকে ব্যাপকভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। 

তাই আমরা বলতে পারি, আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দিন দিন যতই পরিণত হয়েছে, আমেরিকার মন্দাকালীন সময়ে বাংলাদেশের এই রপ্তানি ধরে রাখার সক্ষমতা ততই বেড়েছে। এর মূল কারণ, বাংলাদেশ যে সকলপণ্য রপ্তানি করে থাকে, তা সাধারণত কম মূল্যের পণ্য এবং মন্দাকালীন সময়ে আমেরিকানরা বেশি দামের পণ্য না কিনে কম দামি পণ্যই বরং বেশি কেনে।

তাই আগামীতে যদি সকল দেশের ওপর ধার্য করা এই অতিরিক্ত শুল্কের কারণে আমেরিকায় মন্দা আসে, তাহলে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার আসলে কিছু নেই। বরং এই ধরনের মন্দায় রপ্তানি উল্টো বেড়ে গিয়ে আমাদের জন্য আরো খুশী হওয়ার উপলক্ষ আসতে পারে।

বাংলাদেশের সরকারের উচিত এখন আমেরিকার সরকারের সাথে দেন-দরবারের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত শুল্ক যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। আমেরিকান তুলা ব্যবহার করে তৈরি করা এপারেল আমেরিকাতে রপ্তানি করলে যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায় করে নেয়া যায়, তাহলে বর্তমান বাস্তবতায় আমেরিকাতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আগামীতে বহুগুণে বাড়বে বলে আশা করা যায়।

সর্বশেষ খবর