আহমদ রফিক: অসামান্য সান্নিধ্য

প্রকাশ :

সংশোধিত :

আহমদ রফিক নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় রহস্যপত্রিকার সূত্রে। অষ্টম শ্রেণীতে থাকার সময় প্রথম রহস্যপত্রিকা হাতে পাই। তারপর মোটামুটি নিয়মিত তার পাঠক হয়ে উঠি। ঠিক কোন সংখ্যায় বা কোন সময়ে রহস্যপত্রিকায় আহমদ রফিকের লেখা প্রথম চোখে পড়ে তা বলতে পারবো না। তবে তিনি কয়েক বছর রহস্যপত্রিকায় ‘স্বাস্থ্য বার্তা’বিভাগে লিখেছেন এবং রোগ ও চিকিৎসা বিষয়ে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

অবশ্য স্কুলের পাঠ চুকানোর আগেই দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য পাতায় মাঝে-মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ওপর আহমদ রফিকের লেখা চোখে পড়েছে। সেসব লেখা আমাকে তখন টানেনি, তাই পড়া হয়নি। এছাড়া ফি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রে আহমদ রফিকের লেখা দেখেছি। সেগুলোও তেমন একটা প্রথম দিকে পড়া হয়নি।

তবে এসএসসি পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে বিদায় সংবর্ধনায় মোস্তফা কামাল প্রণীত ‘ভাষা আন্দোলনের ডায়েরি’নামের যে বইটি উপহার পেয়েছিলাম, সেই বইতে প্রথম আহমদ রফিকের ছবি দেখি। একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ছোট বেলা থেকেই আমাকে কেন জানি একটু বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। স্কুলে ছাত্রাবস্থাতেই প্রভাত ফেরি, শহীদ মিনার আর কবিতা পাঠ ঘিরে আমি এক ধরণের উত্তেজনা অনুভব করতাম। ও রকম একটি সময়ে বদরুদ্দীন উমর রচিত ‘আমাদের ভাষার লড়াই’বইটি পড়ি।

অনেককিছুই তখন বুঝতে পারিনি। তবে ভাষা আন্দোলনের ওপর ওটা ছিল আমার পড়া প্রথম বই। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় মহল্লা থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ‘পিলসুঁজ’নামে একটি ছোট্ট সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম যেখানে ভাষা আন্দোলনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরেছিলাম ঐ বইটি অবলম্বন করে। পরবর্তীতে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের বন্ধুমহলের ‘সেতু’ সংকলনের একাধিক সংখ্যা করেছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে। ততোদিনে লেখালিখির নেশা পেয়ে বসেছে। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কিশোর পত্রিকায় নিয়মিত লেখা শুরু করেছি। তখন একদিন সেবা প্রকাশনীর অঙ্গ সংস্থা প্রজাপতি প্রকাশনের কর্ণধার কাজী শাহনূর হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে ঠিক হলো শিশু-কিশোরদের জন্য ছোট করে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের একটি বই লিখব আমি। প্রজাপতি তখন হার্ড বাউন্ডে কিছু গুণগত মানসম্পন্ন বই প্রকাশ শুরু করেছে।

বয়স অল্প থাকায় তখন বুঝিনি যে কাজটা অনেক বড়, দু:সাহসিকও বটে। আমি সুধীজন পাঠাগার থেকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন বই এনে পড়াশোনা করতে লাগলাম। কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটা গল্পাকারে বলে যাচ্ছি-এভাবে কিছুটা বৈঠকী ঢঙে লিখে ফেললাম ‘ভাষা আন্দোলনের গল্প’। পান্ডুলিপিটা দেখার পর কাজী দা (কাজী আনোয়ার হোসেন) আমাকে ডেকে লেখার ঢঙে একটু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন। এও বললেন, ‘এটা এখনই প্রেসে যাওয়া উচিত। তার আগে আহমদ রফিককে বলব একটু দেখে দিতে। উনিতো তোমার এই হাতের লেখা পড়তে পারবেন না। তাই কম্পোজ করে ফাইনাল প্রফটা উনাকে পাঠাবো। তোমার লেখাতেও তো উনার কথা আছে যে উনি ভাষা আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন।’

আহমদ রফিক স্যার বইটা দেখে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন করেছিলেন, দু’তিনটি বিভ্রান্তিকর তথ্য বাদ দিয়েছিলেন। সার্বিকভাবে তাঁর হাত ঘুরে আসায় ছোট্ট বইটির গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বইটির শেষে গ্রন্থপঞ্জীতে তিনি ‘ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও তাৎপর্য’ (আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক রচিত এবং সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত) নামটি যোগ করে দিয়েছিলেন। আর গ্রন্থপঞ্জীর পর কাজী দা’-র সঙ্গে পরামর্শ করে আমি লিখে দিয়েছিলাম: ‘ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত জনাব আহমদ রফিক অনুগ্রহ করে এ বইটির পান্ডুলিপি দেখেছেন ও প্রয়োজনীয় সংশোধন করেছেন।’

১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ হয়। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিন্তু আহমদ রফিকের সঙ্গে আমার তখন কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বইটি দু’বছর পরে (বাংলা ১৪০১ সাল) শিশু একাডেমি থেকে জীবনী-প্রবন্ধ শাখায় অগ্রণী ব্যাংক শিশু-সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল।

এর প্রায় দুই যুগ পরে আহমদ রফিকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় আমার। সেটা ২০১২ সাল। ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর বা পাঁচ যুগ পূর্ণ হচ্ছে। একই ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সুধীজন পাঠাগারের ৪৮ বছর বা চার যুগপূর্তি। সুধীজন পাঠাগার নারায়ণগঞ্জের তথা দেশের অন্যতম বড় বেসরকারি গণগ্রন্থাগার হিসেবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। আমি তখন পাঠাগারের কর্মাধ্যক্ষ। আমার পরিকল্পনাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে পাঠাগারের চার যুগ পূর্তি হবে ভাষা আন্দোলনের পাঁচ যুগ পূর্তির বৃহত্তর ছায়ায়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। ঠিক হলো সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিককে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমার ওপরই সে দায়িত্ব অর্পিত হলো।

আহমদ রফিক তার কয়েক বছর আগ থেকে প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম আলোয় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত, ঘটনা প্রবাহ ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে নিয়মিত লিখছেন। আমিও প্রথম আলোয় কর্মরত। ফলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করাটা কঠিন হলো না। সুধীজন পাঠাগারের বিভিন্ন প্রকাশনাসহ আমি একদিন সকালে ইস্কাটনে তাঁর বাসায় চলে গেলাম। সঙ্গে ছিল পাঠাগারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানিয়ে দেওয়া আনুষ্ঠানিক চিঠি। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে দুই দশক আগে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের গল্প বইটির একটি কপিও নিয়ে গিয়েছিলাম। সব দেখে শুনে তিনি সম্মত হলেন নারায়ণগঞ্জে যেতে।

নির্ধারিত দিন নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার সময় বাঁধল একটু বিপত্তি। বিকেলে অনুষ্ঠান। কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত তখন এক বিভীষিকা। কারণ, গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি উড়ালসড়কের নির্মাণযজ্ঞ চলছে। তাই দুপুর তিনটার সময় তাঁকে নিয়ে বের হওয়ার কথা। তিনি সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু যে গাড়িতে করে যাবো, সে  গাড়ি আসতে আধঘন্টার বেশি দেরি করে ফেলল। ফলে বাসা থেকে যখন তাঁকে তুলতে গিয়েছি, তিনি কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে বলেই ফেললেন যে না যাওয়ার চিন্তা করছেন। সময় রক্ষা না করার বিষয়টি তিনি পছন্দ করেননি। যাহোক, যেতে যেতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হলো। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর লেখালেখি নিয়ে সরাসরি কিছু জানতে পারলাম।

পাঠাগার দেখে আহমদ রফিক স্যার বেশ খুশি হলেন। আমরা যে ২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে নারায়ণগঞ্জের  ভাষা সৈনিকদের সবংর্ধনা দিয়েছিলাম সে তথ্য তাঁকে জানালাম। সেই সময় নারায়ণগঞ্জের ভাষা সৈনিকদের একটি তালিকা আমরা প্রস্তুত করেছিলাম। অসম্পূর্ণ হলেও ওটাই এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ভাষা সৈনিকদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তালিকা। তবে আহমদ রফিক স্যার আমাদেরকে জানালেন যে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যারা মামলা খেয়েছেন ও জেল খেটেছেন, মূলত তাদেরকেই ভাষা সংগ্রামী হিসেবে অভিহিত করা হয়। নারায়ণগঞ্জের তালিকাটি সেভাবে হালনাগাদ করার পরামর্শও দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে আহমদ রফিক স্যারের সঙ্গে আর নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। সুধীজন পাঠাগারের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০১৪ সালে তাঁকে আরেকবার নিতে চেয়েছিলাম। বয়সের ভার ও দূরত্ব বিবেচনায় তিনি সেবার যেতে চাননি। আমিও চাপাচাপি করিনি। শুধু বলেছিলাম,  ‘স্যার, আপনি যেতে পারলে আমরা গর্ব বোধ করতাম।’

তবে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে আমরা যে ৫০টি বই পড়া কর্মসূচি প্রবর্তন করেছিলাম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সর্বসাধারণের জন্য, তাতে বইয়ের তালিকায় আহমদ রফিক রচিত ও প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলন’ বইটি রেখেছিলাম। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পুরস্কারের বইয়ের তালিকায় এই বইটি আমরা রেখেছি।

২.

আহমদ রফিক বাংলাদেশের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। পেশায় চিকিৎসক হয়েও তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। অত্যন্ত সমাজ সচেতন এই ব্যক্তিত্ব বামধারার রাজনীতিতে এক সময় যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন ভাষা সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলনরে ইতহিাস ও তাৎপর্য নিয়ে অনকেগুলো বই লিখেছেন। লিখেছেন চিন্তাশীল অনেক প্রবন্ধ ও গবষেণার্ধমী বই। আছে কবিতার বইও। রবীন্দ্রনাথরে ওপর তাঁর কাজ এতোটাই গভীর ব্যাপ্তির ছিল যে টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে 'রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য' খেতাব দেয়া । তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৬০-য়ের বেশি।

জীবনের শেষ দিনগুলোয় নানা অসুখে ভুগে গত বৃহস্পতিবার ( ২ অক্টোবর, ২০২৫) রাতে ৯৬ বছর বয়সে চির বিদায় নেন তিনি। তবে রেখে যান কিছু অমূল্য কাজ। আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি আহমদ রফিকের সামান্য সান্নিধ্য পেয়েছি, তাঁর মধ্যেই অমর একুশকে অবলোকন করার সুযোগ আমার হয়েছে।

 

[আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক। বর্তমানে দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে পরিকল্পনা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। ২০২২ সালের রহস্যপত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আহমদ রফিক: একুশের কাছে ফেরা’ লেখা থেকে সংক্ষেপ্তি।]

সর্বশেষ খবর