যেসব কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠতে পারে মেট্রোরেল যাত্রা

প্রকাশ :

সংশোধিত :

যানজটের নগরী ঢাকায় মেট্রোরেলের আগমন জনজীবনে এসেছিল স্বপ্নের বার্তা নিয়ে। তবে সেই স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই কেড়ে নিল একটি তরতাজা প্রাণ। রবিবার (২৬ অক্টোবর, ২০২৫) রাজধানীর ফার্মগেটে ঘটে যায় এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা।

নিহত ব্যক্তির নাম আবুল কালাম আজাদ। বয়স ৩৫ বছর। কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকলেও তার পৈতৃক বাড়ি শরীয়তপুর।  মাত্র পাঁচ বছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন আজাদ। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার। তবে মুহূর্তের মধ্যেই যেন সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল।

রবিবার ব্যক্তিগত কাজে ফার্মগেট আসলে হঠাৎ করে মেট্রোরেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড এসে পড়ে আজাদের শরীরে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। আর এমন নির্মম মৃত্যুতে শোকের ছায়ায় ভাসছে গোটা দেশ।

বিয়ারিং প্যাড হলো এক ধরনের মোটা রাবারের তৈরি উপাদান যা মেট্রোরেলের পিলার এবং উপরের কনক্রিটের মাঝামাঝি স্থানে বসানো থাকে। মেট্রোরেল চলার সময় সৃষ্ট কম্পন বা ঝাঁকুনি থেকে রক্ষা পেতেই মূলত এটি ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডার ফলে মেট্রোরেলের কাঠামোর সংকোচন বা প্রসারণ ঘটতে পারে। এতে করে ঘটে যেতে পারে মারাত্নক কোনো দুর্ঘটনা। আর এই ধরনের অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা এড়াতেও মেট্রোরেলের পিলারে বিয়ারিং প্যাড বসানো হয়।

এছাড়া পিলার ও ট্র্যাকের সংযোগে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দেখতে ছোট মনে হলেও এক একটি বিয়ারিং প্যাডের ওজন ১২০-১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাবারের পাশাপাশি এতে ইস্পাতের আস্তরণও ব্যবহার করা হয় যাতে প্যাডটি আরও বেশি টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিয়ারিং প্যাড মেট্রোরেল চলাচলকে নির্বিঘ্ন রাখতে সাহায্য করলেও সামান্যতম ভুল তৈরি করতে পারে মারাত্নক দুর্ঘটনা। কোনও কারণে যদি এসব প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায় তাহলে তা প্রাণহানি থেকে শুরু করে সেখানে থাকা জিনিসপত্রের ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। এছাড়া লাইনে পুনরায় ভারসাম্য আনতে এসময় মেট্রোরেল যাত্রাও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়।

রবিবার বিয়ারিং প্যাড পড়ে আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠেছে। ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কেন বিয়ারিং প্যাডটি ঠিকভাবে বসানো হয়নি এমন প্রশ্ন এখন দেশের সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। এছাড়া কোনও একটি দুর্ঘটনা ঘটার আগে কেন কর্তৃপক্ষ সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না এমন প্রশ্নও তুলেছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

মেট্রোরেলে ব্যবহৃত বিয়ারিং প্যাড নিয়ে ২০২০ সালেই প্রশ্ন ওঠেছিল। সেসময় সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা এটির মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল। ইতাল-থাই ডেভলপমেন্ট কোম্পানি নামক যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব প্যাড সরবারাহ করেছিল সেগুলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের মান অনুযায়ী পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছিল সেসব কর্মকর্তারা।

এছাড়া উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত প্যাড ব্যবহার করে এর আগে থাইল্যান্ডে এমন দুর্ঘটনার নজির আছে যেখানে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এত কিছুর পরও উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা বিয়ারিং প্যাডই ব্যবহার করা হয় মেট্রোরেলের পিলারে।

তবে বিয়ারিং প্যাড ছাড়াও মেট্রোরেল যাত্রার ক্ষেত্রে আরো বেশ কিছু বিষয়ে বাড়তি সচেতনতা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সামান্যতম গাফিলতিও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো যান্ত্রিক ত্রুটি। মেট্রোরেল চলাচলের সময় ইঞ্জিন কিংবা ব্রেকারে কোনো সমস্যা থাকলে তার জন্য ঘটে যেতে পারে মারাত্নক দুর্ঘটনা।

এছাড়া লোড শেডিং কিংবা পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক সংযোগের অভাবেও মেট্রোরেল চলাচলে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটতে পারে। পাশাপাশি শত সার্কিটের বিষয়টিকেও এক্ষেত্রে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এছাড়া সিগন্যালিংয়ের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ত্রুটিও মারাত্নক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। পাশাপাশি চালক ও কর্মীদের দক্ষতার অভাব, স্বয়ংক্রিয় মেশিনের কার্যকারিতায় ত্রুটি, নিয়মিত রক্ষণবেক্ষণের অভাবও প্রাণহানিসহ যে কোনো ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে.

এর আগে ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এর নাট-বল্টু খুলে নেয় এক যুবক। ঘটনাটিকে ভিডিও করে টিকটকে আপলোড করা হলে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে আটক করে পুলিশ। মূলত মজার ছলে এমন কাজ করা হলেও এর ফলে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আর তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে একদিকে এমন কর্তৃপক্ষের নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি ব্যক্তি সচেতনতাও এক্ষেত্রে অপরিহার্য।

tanjimhasan001@gmail.com

সর্বশেষ খবর