থার্ড ম্যান সিনড্রোম: তৃতীয় যে ছায়া হাঁটে পাশে 

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি ছবি : ডেভিড ওয়াল/ গেটি ইমেজেস 

প্রকাশ :

সংশোধিত :

কখনও কি ভেবেছেন, আপনি একেবারে নিঃসঙ্গ, মরুভূমি বা বরফের দেশে, মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, তবু মনে হচ্ছে, পাশে কেউ একজন হাঁটছে? কেউ একজন কথা বলছে, সাহস দিচ্ছে, পথ দেখাচ্ছে? অথচ যখন তাকান, তখন কেউ নেই! এটাই 'থার্ড ম্যান সিনড্রোম'—এক মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা, যেখানে মৃত্যুর খুব কাছে গিয়ে মানুষ অনুভব করে এক রহস্যময় সত্তার সান্নিধ্য।

এই অভিজ্ঞতা বিজ্ঞান আর ধর্ম, বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার মাঝখানে এক অস্পষ্ট রেখার মতো। এটি একাধারে আতঙ্কজনক, আবার আরামদায়কও। এই অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ সময়েই ঘটে চরম বিপদের মুহূর্তে, পর্বতারোহণ, দুর্ঘটনা, সমুদ্রযাত্রা বা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা মানুষের মধ্যে।

শব্দের উৎস ও ইতিহাস

'থার্ড ম্যান' শব্দটি জনপ্রিয় হয় ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত অভিযাত্রী স্যার আর্নেস্ট শ্যাকলটন-এর অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯১৪ সালে তার নেতৃত্বে ‘এন্ড্যুরেন্স’ অভিযানে দক্ষিণ মেরুর পথে তাঁদের জাহাজ বরফে আটকে পড়ে। পরে তিনি ও তাঁর দুই সঙ্গী দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে বেঁচে থাকার লড়াই চালান। এই সময় তিনি অনুভব করেন, “আমরা ছিলাম তিনজন, কিন্তু আমি নিশ্চিত, কেউ একজন চতুর্থ মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল।”

এই 'চতুর্থ ব্যক্তি'র উপস্থিতি এতটাই বাস্তব মনে হয়েছিল যে পরবর্তীতে অনেক অভিযাত্রী তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনায় এমন সত্তার কথা বলেন। তবে সাহিত্যিক টিএস এলিয়টের কবিতা 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড' (১৯২২)-এ এই অভিজ্ঞতার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।

হু ইজ দ্য থার্ড ওয়াকস অলওয়েজ বিসাইড ইউ?/ হোয়েন আই কাউন্ট, দেয়ার আর অনলি ইউ অ্যান্ড আই টুগেদার/বাট হোয়েন আই লুক অ্যাহেড আপ দ্য হোয়াইট রোড/দেয়ার ইজ অলওয়েজ অ্যানাদার ওয়ান ওয়াকিং বিসাইড ইউ...'  (তোমার পাশে সবসময় তৃতীয় যে জন হাঁটে, সে কে?/ গুনে দেখলে, দেখা যায় এখানে কেবল তুমি আর আমি/কিন্তু আমি যখন সামনে তাকাই সাদা রাস্তাটির দিকে/ সবসময় দেখি, আরও একজন হেঁটে যাচ্ছে তোমার পাশে....) এই কবিতার মাধ্যমে 'থার্ড ম্যান' ধারণাটি সাংস্কৃতিকভাবে বিস্তার লাভ করে।

কেন ঘটে এই অভিজ্ঞতা?

থার্ড ম্যান সিনড্রোম একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া—এক প্রকার আত্ম-রক্ষামূলক হ্যালুসিনেশন। যখন শরীর ও মস্তিষ্ক চরম ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, হাইপোক্সিয়া (অক্সিজেনের অভাব), বা মৃত্যুভয় অনুভব করে, তখন মস্তিষ্ক একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে।

এই অদৃশ্য 'সঙ্গী' সেই প্রতিরক্ষা, যার কাজ হলো মানুষকে সাহস দেওয়া, সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা, কিংবা একাকিত্ব দূর করা।

নিউরোসায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি “সেল্ফ-জেনারেটেড কম্প্যানিয়ন”—বিপদের মুহূর্তে মস্তিষ্ক নিজের ভিতর থেকেই তৈরি করে এক সহচর, যাকে মানুষ উপলব্ধি করে একজন আলাদা অস্তিত্ব হিসেবে।

এই ধরনের হ্যালুসিনেশন সিজোফ্রেনিয়া বা অন্যান্য গুরুতর মানসিক ব্যধির মতো নয়। বরং যারা একদম সুস্থ, শুধুমাত্র বিপদের মুখে পড়েছেন, তারাও এই অভিজ্ঞতা পেতে পারেন।

কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা (ফ্র‍্যাঙ্ক স্মাইথ)

১৯৩৩ সালে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে ব্রিটিশ পর্বতারোহী ফ্র্যাংক স্মাইথ মৃত্যুর মুখোমুখি হন। একসময় তিনি অনুভব করেন, পাশে আরেকজন মানুষ হাঁটছে, এমনকি তার জন্য খাবারও ভাগ করে রাখেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আসলে একাই ছিলেন।

রোনাল্ড ফ্রান্‌জ

৯/১১ হামলার সময় টুইন টাওয়ার থেকে পালাতে গিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া একজন কর্মী বলেন, "একজন নারী কণ্ঠ আমাকে বলছিল—‘ওঠো, হেঁটে বেরিয়ে যাও।’ আমি তখন অন্ধকারে পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু তার কণ্ঠ অনুসরণ করেই বের হতে পেরেছিলাম।"

মানবিকতা ও বেঁচে থাকার প্রেরণা

এটা সত্য, এই অভিজ্ঞতার কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ নেই। তবে প্রমাণ রয়েছে যে, এই অভিজ্ঞতা বহু মানুষকে বাঁচিয়ে তুলেছে। কেউ কেউ বলেন, “আমি বাঁচতে পারতাম না, যদি না কেউ আমার পাশে সাহস জোগাত।” এই ‘কেউ’ আসলেই যদি নিজের মনেরই প্রতিফলন হয়, তাহলে কি বলা যায় না, আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আমাদের তৃতীয় সঙ্গী?

অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেন, এটি এক ধরনের 'কোপিং ম্যাকানিজম' এক ধরনের মানসিক রক্ষাকবচ।

থার্ড ম্যান সিনড্রোম এক রহস্যময় এবং মানবিক অভিজ্ঞতা—যা আমাদের শেখায়, মানুষ যখন চরম একাকিত্বে পড়ে, তখন তার ভেতরের শক্তিই একটি সত্তা হয়ে তাকে পথ দেখায়। হয়তো আমাদের সবার মধ্যেই আছে এমন একজন তৃতীয় মানুষ—যে শুধু ভয়ঙ্কর মুহূর্তেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, আশ্বাস দিয়ে বলে, “আমি আছি, একা নও তুমি।”

mahmudnewaz939@gmail.com

সর্বশেষ খবর