সেন্টমার্টিন ভ্রমণে ট্রাভেল পাস: নীল সমুদ্রের শান্তি ফেরাতে মানতে হবে যে ১২ নিয়ম

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি ছবি : সামিউজ্জামান সাকিব, পেক্সেলস

প্রকাশ :

সংশোধিত :

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যেন নীল আর সবুজের মায়াময় সংমিশ্রণ। নৌযান থেকে নামতেই চোখে পড়ে নীল জলের ঝলকানি, কেয়া বনের স্নিগ্ধতা আর দূরে দিগন্তজোড়া সমুদ্রের ডাক। কিন্তু এই মায়াময় সৌন্দর্য এখন আর অবাধ নয়—দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার এবার দিয়েছে নতুন এক নির্দেশনা, যেতে হলে লাগবে ট্রাভেল পাস।

সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ১২টি নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে পর্যটন হয় নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব। সহজভাবে বলতে গেলে, সেন্টমার্টিন এখন ‘ওপেন আইল্যান্ড’ নয়, বরং একটি সংরক্ষিত অঞ্চল—যেখানে ঢোকার আগে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি 'দায়বদ্ধ ভ্রমণকারী।'

ট্রাভেল পাস: ভ্রমণের নতুন পরিচয়পত্র

এখন থেকে কোনও যাত্রী ইচ্ছেমতো গিয়ে টিকিট কেটে দ্বীপে উঠতে পারবেন না। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত ওয়েব পোর্টাল থেকে অনলাইনে টিকিট নিতে হবে, যার সঙ্গে থাকবে একটি কিউআর কোডযুক্ত ট্রাভেল পাস। বন্দরে সেই কিউআর স্ক্যান করেই অনুমতি মিলবে যাত্রার। অর্থাৎ, দ্বীপে যাওয়ার পথে প্রযুক্তিই হবে নিয়ন্ত্রক।

এই ব্যবস্থায় নকল টিকিট, অতিরিক্ত যাত্রী এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছে প্রশাসন।

সবচেয়ে বড় বিষয়, প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটকই এখন সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন। আগে যেখানে দিনে ৮–১০ হাজার মানুষ ঢুকে পড়তেন, সেখানে এখন সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করছে প্রশান্তি ও শৃঙ্খলা।

১২টি নির্দেশনা: সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের নতুন বিধিবিধান 

১. অনুমোদিত নৌযান ছাড়া কেউ যেতে পারবে না: কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়া সব জাহাজ ও ট্রলারকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।

২. টিকিট নিতে হবে অনলাইনে: বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নির্ধারিত ওয়েবসাইট থেকেই টিকিট কেনা যাবে, যাতে কিউআর কোডসহ ট্রাভেল পাস থাকবে। 

৩. কিউআর কোড ছাড়া টিকিট অকার্যকর: কিউআর স্ক্যান ছাড়া যাত্রা শুরু করা যাবে না—এভাবে নকল টিকিট প্রতিরোধ করা হবে।

৪. দৈনিক সর্বোচ্চ ২ হাজার পর্যটক সীমা:  নির্ধারিত সংখ্যার বেশি কেউ যেতে পারবে না, যাতে দ্বীপে ভিড় ও পরিবেশদূষণ না ঘটে।

৫. নভেম্বর মাসে শুধুমাত্র দিনভ্রমণ: এই সময়ে কেউ রাতযাপন করতে পারবে না।

৬. ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাতযাপন অনুমোদিত: শীতের মৌসুমে সীমিত সংখ্যক পর্যটককে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে।

৭. ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকবে। এই সময়ে প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপ পুনরুদ্ধারের সুযোগ পাবে। 

৮. পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ: চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক বোতল, মিনিপ্যাক সাবান বা শ্যাম্পু বহন নিরুৎসাহিত; নিজের ফ্লাস্ক নিয়ে যেতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। 

৯. সৈকতে মোটরচালিত যান নিষিদ্ধ: মোটরসাইকেল, সি-বাইক ইত্যাদি পরিবেশের ক্ষতি করে, তাই এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ।

১০. কেয়া বনে প্রবেশ বা ফল সংগ্রহ নিষিদ্ধ: প্রবাল, রাজকাঁকড়া, কাছিম, শামুক-ঝিনুকের মতো জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় এমন কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

১১. রাতে আলো জ্বালানো বা উচ্চ শব্দে পার্টি নিষিদ্ধ: সমুদ্রের পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণীরা যাতে শান্তিতে থাকতে পারে, তার জন্য এই ব্যবস্থা।

১২. দ্বীপে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে: প্রশাসনের নজরদারিতে থাকবে পুরো পর্যটন প্রক্রিয়া—যানবাহন, আবাসন, এমনকি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও।

প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা

এই নির্দেশনাগুলো শুনে কারও কাছে হয়তো কঠোর মনে হতে পারে। কিন্তু ভাবুন তো—এই দ্বীপে প্রবালগুলো যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, কাছিমরা যদি আর ফিরে না আসে, তাহলে আমাদের ‘স্বর্গদ্বীপ’ কীভাবে টিকে থাকবে?

এই পদক্ষেপগুলো মূলত প্রকৃতিকে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। সীমিত ভ্রমণ, প্লাস্টিকবর্জন আর শৃঙ্খলিত যাত্রা—এই তিনেই টিকে থাকবে সেন্টমার্টিনের প্রাণ।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সেন্টমার্টিন এখন কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, বরং একটি পরিবেশ-সচেতন অভিজ্ঞতার জায়গা।

ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একরকম পরীক্ষা—তারা কি শুধু ছবির জন্য সমুদ্র চায়, নাকি তার প্রাণও টিকিয়ে রাখতে চায়?

mahmudnewaz939@gmail.com

সর্বশেষ খবর