শাওনস কেনেল: ঢাকার বুকে পাহারাদারদের খামার

জার্মান শেফার্ডের সাথে খামারের উদ্যোক্তা রিয়াদ মাহমুদের ছেলে ইল্লিন মাহমুদ আরিয়ান
জার্মান শেফার্ডের সাথে খামারের উদ্যোক্তা রিয়াদ মাহমুদের ছেলে ইল্লিন মাহমুদ আরিয়ান

প্রকাশ :

সংশোধিত :

ঢাকার খিলগাঁওয়ের ইটাখোলা—নদী, ডোবা, সরু মাটির রাস্তা আর নিস্তব্ধ বিকেল। দূর থেকে ভেসে আসে হুংকারের শব্দ, যেন অদৃশ্য কোনও সেনাদল প্রস্তুতি নিচ্ছে অজানা যুদ্ধে। এগুলো রিয়াদ মাহমুদের কুকুর। তার খামার ‘শাওনস কেনেল’ এখন রাজধানীর মধ্যেই এক অদ্ভুত জগৎ।

শখ থেকে শুরু

রিয়াদ মাহমুদ ছোটবেলা থেকেই প্রাণীপ্রেমী। বাড়িতে ছিল জার্মান শেফার্ড, বিড়াল, পাখি, সবই তার জীবনের অংশ। কিন্তু তিনি কখনও ভাবেননি, একদিন কুকুরই হবে তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

২০১৮ সালে তিনি চার কাঠা জমি কিনে গড়ে তোলেন পাহারাদার কুকুরের খামার।

শুরুতে বিদেশ থেকে কয়েকটি কুকুর আমদানি করেছিলেন, পরে সেখান থেকেই প্রজননের মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন প্রজন্ম। এখন তার খামারে ২৬টি বড় কুকুর আছে, যাদের মধ্যে কিছু জার্মান শেফার্ড, কিছু ইতালিয়ান ম্যাসটিফ, কিছু বুল ম্যাসটিফ—সবই নামকরা প্রজাতি।

জন্মের আগেই বিক্রি

খামারের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় বাচ্চা জন্মের মৌসুমে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাচ্চাগুলো জন্মানোর আগেই বিক্রি হয়ে যায়। ক্রেতারা আগে দেখে নেন মা-বাবা কুকুরকে, তারপর বুকিং দেন। একেকটি কুকুরছানার দাম ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। জার্মান শেফার্ডের বাচ্চা ৪০ হাজার, আর ইতালিয়ান বা ইংল্যান্ডের ম্যাসটিফ ৬০ হাজারে বিক্রি হয়।

রিয়াদ বলেন, “আমাদের বাচ্চাগুলো জন্মের আগেই বুকিং হয়ে যায়। মা-বাবার শারীরিক গঠন, স্বভাব, প্রশিক্ষণ দেখে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়।” গর্ভকাল প্রায় ৬৪ দিন। একবারে আট–নয়টি বাচ্চা দেয়, তবে মায়ের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বছরে একবারই প্রজনন করানো হয়।

প্রশিক্ষিত রক্ষী

তিন মাস বয়স থেকেই শুরু হয় প্রশিক্ষণ। পাঁচ মাস পেরোলেই তারা পাহারা দিতে প্রস্তুত। কুকুরগুলোর ঘাড় পর্যন্ত উচ্চতা ৩১ ইঞ্চি, দুই পায়ে দাঁড়ালে প্রায় ছয় ফুট। লাফিয়ে ১৫ ফুট পর্যন্ত দেয়াল টপকাতে পারে। ওজন ৫০ থেকে ১২০ কেজির মধ্যে। জার্মান শেফার্ডের কামড়ের জোর ২২৮ পিএসআই, ইতালিয়ান ম্যাসটিফের দাঁতের চাপ ৭০০ পিএসআই যা সিংহের চেয়েও বেশি।

এই কুকুরগুলোর বাচ্চা কিনে নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, পিবিআই, এসএসএফসহ নানা সংস্থা। আবার অনেক ব্যবসায়ী বা কারখানার মালিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও কেনেন।

রিয়াদ বলেন, “একটা কুকুর ঘুষ বোঝে না, ভয় পায় না। সে শুধু নিজের দায়িত্ব বোঝে। তাই ওদের ভরসা করা যায়।”

পরিবারই কর্মী

খামারের প্রতিটি কাজে পাশে আছেন স্ত্রী লুবনা ইয়াসমীন ও ছেলে ইল্লিন মাহমুদ আরিয়ান। কোনও কর্মী রাখেননি রিয়াদ, কারণ সবাই ভয় পায়। লুবনা নিজে রান্না করেন কুকুরদের জন্য। রুটি, মাংস, সবজি, দুধ, কলা, টোস্ট বিস্কুট, এমনকি মুরগির পায়ের স্যুপ এদের খাবার। দুপুরে থাকে খিচুড়ি, রাতে মাংস ও কার্বোহাইড্রেটভিত্তিক খাবার।

“প্রায় সারাদিনই ওদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়,” বলেন লুবনা, “ আমরা ওদের সন্তান হিসেবেই দেখি।”

ইল্লিন পড়াশোনায় কিছুদিন বিরতি দিয়েছে, বাবার সঙ্গে পুরো সময় কাজ করছে খামারে। “বন্ধু কম, কারণ সবাই কুকুর পছন্দ করে না,” হেসে বলে ইল্লিন, “যারা করে, তারাই আসলে বুঝতে পারে এই ভালোবাসা।” ডাকেন আলাদা নামে। রিয়াদের কুকুরগুলো ভয়ঙ্কর হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক অন্যরকম। খামারের ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়—বেহুলা, হিরো, টম, ব্র্যান্ডি—সব কুকুরই তার ডাকে ছুটে আসে। কেউ গায়ে ঘষে, কেউ হাত চেটে দেয়।  “বেহুলা চুপ” বললে সে সত্যিই চুপ হয়ে যায়।

রিয়াদ হাসেন, “অনেকে বলে আমি কুকুর নিয়ে পাগলামি করছি। কিন্তু এগুলো কুকুর না, আমার বাচ্চা। আমি ওদের নামেই ডাকি, বাচ্চা বলেই ডাকি।”

ভালোবাসা ও ভয় একসঙ্গে

বাহিরের মানুষের কাছে এগুলো ভয়ঙ্কর; ভেতরের মানুষের কাছে, পরিবারের মতো।

রিয়াদ বলেন, “ওরা নিজের এলাকা চেনে, পরিবারের গন্ধ বোঝে। বাইরে কেউ ঢুকলে ওরা সাথে সাথে সিগন্যাল দেয়। তবে পরিবারের কাউকে কখনো কামড়াবে না।” এই কারণেই তাদের খামারে প্রবেশের আগে দরজা দুটি তালাবদ্ধ থাকে। একবার ঢুকলে কুকুরের দৃষ্টি এড়ানো যায় না। তবু রিয়াদদের মুখে ভয় নয়, বরং গর্ব।

কঠিন পেশা, কঠিন ভালোবাসা

এই ব্যবসা লাভজনক হলেও চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিয়মিত খাবার, টিকা, চিকিৎসা, সবই ব্যয়বহুল। বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বিক্রি হয়, খরচ বাদে থাকে ২০–২২ লাখ। কিন্তু এই টাকা আবার খামারের উন্নয়নেই ফিরে যায়। “এটা শুধু ব্যবসা নয়, আমাদের জীবনধারা,” বলেন রিয়াদ- “পরিবারের সবাই একসঙ্গে না থাকলে এই কাজ অসম্ভব।'' 

বাণিজ্য ও নৈতিকতা

বছরে ৫০ লাখ টাকার ব্যবসা হয় খামারে, খরচ বাদে থাকে প্রায় ২০–২২ লাখ। লাভজনক এই খাতে প্রতারণারও আশঙ্কা আছে, তাই রিয়াদ সন্দেহজনক ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন না। “অনেকে কুকুর নেয় প্রতিবেশীকে ভয় দেখাতে, তাদের বাচ্চা দিই না,” বলেন তিনি।

তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়—খাবারের খরচ, পরিচ্ছন্নতা, পারিপার্শ্বিক অভিযোগ, আর ক্রমবর্ধমান জায়গার সংকট। তাই পাশে আরও ১১ কাঠা জমি কিনেছেন তিনি, নতুন স্থাপনার পরিকল্পনা চলছে।

শাওনস কেনেল-এর প্রতিদিন

ভোরে শুরু হয় দিন। কুকুরগুলো একে একে ঘর থেকে বের হয়, কেউ দৌড়ায়, কেউ নদীর ধারে ঘোরে। এরপর খাওয়ানো, গোসল, প্রশিক্ষণ, বিকেলে বিশ্রাম।

লুবনা বলেন, “ওদেরও রুটিন আছে। যেমন আমাদের সন্তানদের থাকে স্কুল, খাওয়া, ঘুম—ওদেরও তেমন।” রাতে কিছু কুকুরকে পাহারায় রাখা হয়, বাকিরা ঘুমায় নির্দিষ্ট ঘরে। আশপাশের গ্রামজুড়ে নীরবতা নেমে আসে, শুধু মাঝেমধ্যে দূর থেকে শোনা যায় এক–দুটি ঘেউঘেউ।

রিয়াদের স্বপ্ন, একদিন আন্তর্জাতিকভাবে তার খামারের বাচ্চা বিক্রি হবে। “বাংলাদেশেও এখন অনেকেই পোষা প্রাণী নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে,” বলেন তিনি। “আমি চাই, দেশেই মানসম্পন্ন পাহারাদার কুকুর তৈরি হোক।” ইটাখোলার সেই নির্জন জায়গায়, যেখানে একসময় কেউ আসতো না, এখন আসে বিজিবি, পুলিশ, এমনকি বিদেশি ক্রেতাও। কুকুরের চিৎকারে কেঁপে ওঠে বাতাস, কিন্তু তার ভেতর লুকিয়ে থাকে এক পরিবারের হাসি, পরিশ্রম আর নিবেদন।

ইটাখোলার সেই নির্জন প্রান্তে, যেখানে একসময় মানুষের আনাগোনা ছিল কম, এখন শোনা যায় কুকুরের সমস্বরে ডাক। রিয়াদ মাহমুদের এই ‘পাহারাদারদের খামার’ প্রমাণ করছে—ভালোবাসা, শৃঙ্খলা আর সাহস একবিন্দুতে মিলে গেলে, পশুরাও হয়ে ওঠে মানুষের বিশ্বস্ত সহচর ও রক্ষী।

mahmudnewaz939@gmail.com

সর্বশেষ খবর