পুতুল কথন: শৈশব ছাড়িয়ে শিল্পের খোঁজে

প্রকাশ :
সংশোধিত :

"ভোর বেলা যে খেলার সাথী ছিল আমার সাথে, মনে ভাবি তার ঠিকানা তোমার জানা আছে” অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই আমাদের কাছে পুতুলকে পরিচয় করে দিয়েছেন।
ছোটবেলায় পুতুলের বিয়ে দেয়নি এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। পুতুল আমাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সাক্ষী। পুতুলকে শৈশবের প্রথম সখি বললেও ভুল হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিম মাহবুব জানান তিনি মেলাতে গেলেই পুতুল খুঁজেন। নিজের পুতুল নিয়ে তিনি বলেন "পুতুল আমার কাছে সন্তানের মতো আবার বন্ধুর মতো। যে কথাগুলো আসলে কাউকে বলা যায় না বাইরে সেগুলো তাদের সাথেই বলা যায়, কারণ ওরা শুধু শুনেই যায়।"
পুতুল বললেই যদি আপনার চোখে হালের বার্বি পুতুলের ছবি ভেসে ওঠে তাহলে কিন্তু ভারি অন্যায় করা হবে আমাদের পুতুলদের প্রতি। হ্যাঁ, আমাদের নিজস্ব পুতুলদের কথাই বলবো আজ।
ইতিহাস বলে, হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারো সভ্যতা মাটির পুতুল ও খেলনার বিশাল সম্পদ তৈরি করেছিল। কয়েক শতক পর্যন্ত সেই একই ছাঁচে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে মাটির খেলনা ও পুতুল তৈরি হয়ে এসেছে। এই অঞ্চলের ফাইন আর্ট বা ফিগারেটিভ আর্ট বলতে ছিলই মাটির পুতুল।
বাংলাদেশের সাভার, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, বারোবাজার, দিনাজপুর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পুতুল পাওয়া যায়।
শাওন আকন্দ ‘বাংলাদেশের লোকশিল্পের রূপরেখা’য় বলেছেন বাংলাদেশের মাটির পুতুল তৈরির কিছু কেন্দ্র রয়েছে- ধামরাইয়ের কাগজীপাড়া, সাভারের কাকরান ও কুমিল্লার বিজয়পুরসহ আরও অনেক।
নিজের কল্পনাকে বাস্তবিক রূপ দেয়ার জন্য বাংলার উর্বর মাটিকেই কারিগররা বেছে নেন।
এঁটেল, দোআঁশ বা এই দুটোর মিশ্রণের ব্যবহার দেখা যায় এই শিল্পে। পাশাপাশি পিতল, অষ্টধাতু, তালপাতা, কাঠ, বাঁশ, শোলা, পাট, কাগজ , কাপড় দিয়েও পুতুল তৈরি হয়। শিল্পীর নিপুণ হাতে, আগুনের তাপে পুড়ে জন্ম নেয় হাতি, ঘোড়া ও সিংহসহ, নানা রঙ ও নানা ঢঙ্গের দেব-দেবীর মতো পুতুল।
ঐতিহ্যবাহী পুতুলগুলোর রয়েছে বাহারি নাম ও গল্প। লোককাহিনী, পুরানের বিভিন্ন চরিত্র এই পুতুলের প্রধান উপজীব্য হয়ে থাকে।
অঞ্চলভেদে পুতুলের ধরনও হয়ে থাকে ভিন্ন। যেমন, টেরাকোটার পুতুল। টেরাকোটার পুতুলের প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর ও ময়নামতি এদের আদিনিবাস।
হাত দিয়ে টিপে টিপে বানানো এই পুতুল ময়মনসিংহে গিয়ে হয়ে যায় টিপা পুতুল বা কোনা পুতুল। পাবনায় আবার এর নাম গোয়ালিনী। কৃষ্ণের বন্ধু গোপীর অনুকরণে এই নামকরণ।
কাঠের পুতুল বাংলাদেশের আরেক ঐতিহ্য। সিঁদুর লাল রঙের শাড়ির সাথে মাথায় খোঁপা করা এই পুতুল আমাদের অতি পরিচিত।
এই ধরনের পুতুল তৈরিতে কদম, আমড়া, জিওল, শ্যাওড়া, ছাতিম, শিমুল প্রভৃতি কাঠ ব্যবহৃত হয়। এটি তৈরি করার জন্য অর্ধগোলাকৃতি বা ত্রিকোণাকার কাঠ ছোট করে কেটে নেয়া হয়। পরে উজ্জ্বল রঙের সাহায্যে অবয়ব আঁকা হয়। একে মমি পুতুলও বলা হয়।
এরপর আছে কাপড়ের পুতুল। কাপড়ের পুতুল তৈরি করা হয় পুরোনো শাড়ি বা ফেলে দেওয়া জামার টুকরা দিয়ে।
কাঠি দিয়ে বানানো হাত-পা আর দুই বেনুনিসহ এই পুতুলগুলো শহরে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। বর-কনে, বেদেনি, মনিপুরি নাচের পুতুল এড় পরিচিত রূপ।
এখন আসি শোলার পুতুলের কথায়। মাগুরা, ফরিদপুর, রাজশাহী , ঢাকার শাঁখারিবাজারে তৈরি হয় এই পুতুল। শোলা কেটে জোড়া লাগিয়ে এইসব পুতুল তৈরি করা হয়। তবে এগুলো টেকসই বয় বলে ব্যবহার কম।
এছাড়াও রয়েছে নড়াইলের ঘাড় নাড়া বুড়ো পুতুল, যশোরের চিনির পুতুল, ফরিদপুরের তালপাতার সেপাই পুতুল ও ইত্যাদি।
পুতুল শুধু শিশুদের খেলার অনুষঙ্গই নয় বরং এটা মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের এক অনন্য শিল্পরূপ। কারখানায় তৈরি পুতুলের জাঁকজমকের সামনে হাতে গড়া পুতুল অনেকটাই ম্লান। তবে এদের পিছনে রয়েছে আবেগ, ঐতিহ্য ও কারিগরের অক্লান্ত পরিশ্রম। তাই এই জীবন সংস্কৃতিকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।
nabilarahimprapty@gmail.com

