প্রাচীন মিশরের গোরস্থানে মিলল 'বুক অব দ্য ডেড' এর সন্ধান

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রকাশ :

সংশোধিত :

প্রাচীন মিশরীয়রা কীভাবে জানতো মৃত্যুকেও যে মহিমান্বিত আয়োজনে রূপ দেয়া যায়। তাদের কবরের ভেতর রাখা হতো মৃতদেহের অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য ক্যানোপিক জার, আর সঙ্গে থাকতো বুক অব দ্য ডেড বা 'মৃতদের বই'-এর পাণ্ডুলিপি, যা মৃতকে পরকালীন জীবনের পথের দিকনির্দেশনা দিতো।

বুক অব দ্য ডেড (মৃতদের বই) প্রাচীন মিশরের এক ধরনের শবসংক্রান্ত পাঠ্যসংগ্রহ, যেখানে নানা মন্ত্র ও জাদুকরী সূত্র লিপিবদ্ধ। পরকালে মৃত ব্যক্তির সুরক্ষা ও সহায়তার জন্য এগুলো সমাধির ভেতরে রাখা হতো।

ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৬শ শতকে এই গ্রন্থটির সংকলন ও পুনঃসম্পাদনা সম্পন্ন হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল কফিনে লেখা লিপি, যার সময়কাল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ এবং পিরামিডের লিপি, যার সময়কাল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দ। এর পাশাপাশি অন্য অনেক লেখা ও স্তোত্রও যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সংকলনগুলোতে সূর্যদেব 'রে'-কে উদ্দেশ করে রচিত স্তোত্রও ছিল।

এই গ্রন্থের পেছনে বহু লেখক, সংকলক ও উৎসের অবদান রয়েছে। লেখকরা এগুলো প্যাপিরাসের রোল বা গ্রন্থিতে লিখে রাখতেন, অনেক সময় রঙিন চিত্র দিয়ে অলঙ্কৃত করতেন, এবং এগুলো মৃতব্যক্তিদের কবরের জন্য বিক্রি করতেন। এই বইয়ে টোটাল ২০০ টা অধ্যায়। কিন্তু যেসব সমাধিক্ষেত্রে এটার অনুলিপি (কপি) পাওয়া গেছে, কোনোটাতেই ২০০ টা চ্যাপ্টার পাওয়া যায়নি।

গ্রন্থটির মূল নাম ছিল “দিবালোকে বেরিয়ে আসার অধ্যায়সমূহ” (দ্য চ্যাপ্টার্স অব কামিং ফোর্থ-বাই-ডে)। জার্মান মিশরতত্ত্ববিদ কার্ল রিচার্ড লেপসিয়াস ১৮৪২ সালে প্রথমবার পাঠ্যগুলোর সংকলন প্রকাশ করেন এবং সেখান থেকেই 'বুক অব দ্য ডেড' নামটি প্রচলিত হয়।

সম্প্রতি মিশরের মধ্যভাগে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন এমনই এক চমকপ্রদ সমাধিক্ষেত্র। ৩,৫০০ বছর পুরনো এই নিউ কিংডম যুগের সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া গেছে মমি, তাবিজ, মূর্তি, ক্যানোপিক জার এবং প্রায় ৪৩ ফুট লম্বা এক প্যাপিরাস স্ক্রোল। এই স্ক্রোলে রয়েছে বুক অব দ্য ডেড-এর অংশবিশেষ।

এটি আল-ঘুরাইফা এলাকায় পাওয়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্যাপিরাস। মিশরের পর্যটন ও প্রত্নসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক আরবি বিবৃতি অনুবাদ করে দেশটির সুপ্রিম কাউন্সিল অব অ্যান্টিকুইটিস-এর মহাসচিব মোস্তফা ওয়াজিরি জানিয়েছেন, এটি 'ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত' রয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ১০৭০ সালের মধ্যে তৈরি এই সমাধিক্ষেত্র তার শত শত প্রত্নবস্তু ও শিলাখোদিত সমাধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর মধ্যেই বুক অব দ্য ডেড-এর একটি কপি আবিষ্কার বিশেষজ্ঞদের কাছে বিশেষভাবে মূল্যবান।

তারা মনে করছেন এটি এক বিরল সম্পদ। তবে ৪৩ থেকে ৪৯ ফুট দীর্ঘ বলে ধারণা করা এই স্ক্রোলের সঠিক বিষয়বস্তু এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তাই এই সংস্করণ নিয়ে অনেক প্রশ্নই এখনো অজানা।

এই ধরনের পাঠ্য, যা লেখকের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে, প্রথম দেখা দেয় নিউ কিংডম যুগের শুরুতে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ সালের দিকে। ফলে ওই সময়কার 'ভালো অবস্থায়' পাওয়া একটি কপি নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর ঘটনা। 

“যদি এটি এত দীর্ঘ হয় এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকে, তবে এটি নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত ও আকর্ষণীয় এক আবিষ্কার,” বলেছেন জার্মানির রোমার ও পেলিজায়ুস মিউজিয়ামের প্রধান নির্বাহী লারা ওয়েইস।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশরবিদ ফয় স্কালফ লাইভ সায়েন্স-কে জানিয়েছেন, কোনও সমাধিতে মূল কপিসহ এমন একটি আবিষ্কার 'খুবই বিরল।' তবে ছবি ও আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা ছাড়া এর বিস্তারিত যাচাই করা এখনও কঠিন। বইটির যেকোনো সংস্করণ গবেষকদের জন্য প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস ও পরকালীন ধারণা বোঝার গুরুত্বপূর্ণ উৎস, জানিয়েছে আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার ইন ইজিপ্ট।

কেন্দ্রটির মতে, “বুক অব দ্য ডেড প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় দিকগুলো উন্মোচন করে। আর মিশরতত্ত্বে যেমনটি ঘটে, আমাদের তত্ত্বগুলো প্রতিটি নতুন অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়, বিস্তৃত হয় এবং নতুন আকার নেয়।”

যদিও গবেষকদের কাছে বুক অব দ্য ডেড এখনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। মিশরীয় মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী এটি ভবিষ্যতে গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হবে। তবে এ টেক্সটই সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া একমাত্র সম্পদ।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন পাথর ও কাঠের কফিনে সংরক্ষিত মমি, ২৫ হাজারেরও বেশি উশাবতি মূর্তি, অসংখ্য ব্যবহার্য সামগ্রী, হাজারও পাথর ও কাঠের তাবিজ এবং ক্যানোপিক জার। খোদাই করা ও রঙিন কাঠের কফিনগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল তা-দে-ইসা নামের এক নারীর কফিন।

তিনি ছিলেন আল-আশমুনিন এলাকার দেবতা জেহুতির উচ্চ পুরোহিত এরেত হারুর কন্যা। তার কফিনের পাশে পাওয়া গেছে দুটি কাঠের বাক্স, যাতে ছিল তার ক্যানোপিক পাত্র। এর পাশাপাশি ছিল সম্পূর্ণ উশাবতি মূর্তির সংগ্রহ এবং উটপাখির মতো আকৃতির দেবতা প্থাহ সোকারের একটি মূর্তি।

mahmudnewaz939@gmail.com

সর্বশেষ খবর