অপারেশন হাইজাম্প: হিমশত্রুর কবলে আমেরিকার গোপন মেরুযুদ্ধ

প্রকাশ :

সংশোধিত :

১৯৪৬ সালের শেষ ভাগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ছায়া এখনও মানবজাতির ওপর চাপিয়ে রেখেছে ক্লান্তি আর আতঙ্ক। জার্মানি হারলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি, শুধু রণক্ষেত্র বদলেছে। সেই নতুন রণক্ষেত্র এবার পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন, রহস্যময়, এবং শ্বেতশুভ্র ভূমি—আন্টার্কটিকা!

আকাশে ঘন কালো মেঘ, সমুদ্র উত্তাল, আর তুষারঝড়ের গর্জনে জাহাজ কাঁপছে। বিশাল বিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস ফিলিপাইন সি এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ মেরুর দিকে, সঙ্গে ১২টি সহযাত্রী জাহাজ, ৪ হাজার ৭০০ জন সেনা, বিজ্ঞানী, টেকনিশিয়ান আর পাইলট।

রাডারে বরফের বিস্তীর্ণ ভূমি ধরা পড়ছে, নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে উড়োজাহাজ—ডগলাস আরডি স্কাইট্রেইন, বরফের বুকে ল্যান্ড করছে। এটাই অপারেশন হাইজাম্প, যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় দক্ষিণ মেরু অভিযান।

লক্ষ্য মানচিত্র তৈরি করা, ঘাঁটি স্থাপন করা, বরফের নিচের সম্ভাব্য খনিজ সম্পদ চিহ্নিত করা, এবং কঠিন পরিবেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া। তবে ফিসফিস করে আরেকটা উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পড়ছে—নাৎসিদের শেষ গোপন ঘাঁটি খোঁজা। বলা হচ্ছে, হিটলার মরেনি; তিনি পালিয়ে গেছেন এই বরফে ঢাকা ভূমিতে।

রিয়ার অ্যাডমিরাল রিচার্ড ই. বার্ড—এই অভিযানের কমান্ডার, একজন অভিজ্ঞ অভিযাত্রী, তার চোখে ঘুম নেই। তিনি জানেন, আনুষ্ঠানিকভাবে এটি একটি বৈজ্ঞানিক মিশন, কিন্তু প্রকৃত চিত্র আরও গভীর, আরও ঠান্ডা।

জাহাজগুলো যখন নিউ সোয়াবিয়া অঞ্চলের কাছাকাছি আসে, এই অঞ্চলটি আগে নাৎসি জার্মানি দাবিকৃত বলে পরিচিত ছিল, তখন রাডারে ধরা পড়ে অদ্ভুত সব আকৃতি। একটি ছোট স্কোয়াড পাইলট বিমান নিয়ে এগোয়। সাদা বালির মতো তুষারপৃষ্ঠে একটি বিশাল গুহার মতো প্রবেশপথ দেখা যায়। গুহার ভেতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। পাইলট রিপোর্ট দেয়, “মনে হচ্ছে কোনো জিওথার্মাল গরম বাতাস আসছে ভেতর থেকে।”

হঠাৎ রেডিওতে গোলযোগ। একটি স্কোয়াড নিখোঁজ। আরেকটি বিমান জরুরি অবতরণ করে। পাইলট চোখে আতঙ্ক। সে বলছে, আকাশ থেকে যেন ধাতব চাকতির মতো কিছু ভেসে আসছিল, শব্দহীন, রাডারে ধরা পড়ে না।

ক্যাম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। 'নতুন ধরণের অস্ত্র?', 'রাশিয়ান?', 'নাৎসিদের গোপন প্রযুক্তি? 'অনেকে বলে এটা ‘ফ্লাইং ডিস্ক’। কেউ বলছে, এলিয়েন!

দিন যত এগোয়, আবহাওয়া ততো খারাপ হয়। ঝড়, তুষারপাত, বরফপাত, টেন্ট উড়িয়ে নেয়, সরঞ্জাম হারায়। একরাতে তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৫০ ডিগ্রিতে। তিনজন সদস্য বরফের নিচে চাপা পড়ে মারা যান।

অভিযানপথ বদলানো হয়। একটি দলে পাঠানো হয় পূর্বদিকে, যেখানে বরফের নিচে কিছু ধাতব স্তরের ইঙ্গিত মিলেছে। বরফ কেটে কেটে পৌঁছানো হয় সেখানে। বিজ্ঞানীরা জানান, এটা সম্ভবত পুরনো কোনো আগ্নেয়গিরির খনিজ। কিন্তু একজন সৈনিক চুপিচুপি ছবি তোলে একটি প্লেট-আকৃতির ধাতব বস্তুর। ফাইল ক্লাসিফায়েড হয়ে যায়। এদিকে অ্যাডমিরাল বার্ড নিজের ডায়েরিতে লিখছেন, “আমরা এমন কিছু দেখেছি, যা আমাদের প্রযুক্তির ধারণক্ষমতার বাইরে।”

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭। মিশন হঠাৎ সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়। কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। জাহাজগুলো ফিরতে শুরু করে। সংবাদমাধ্যমে শুধু বলা হয়, আবহাওয়া ও সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে মিশন শেষ। কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়।

পরে ফরচুন ম্যাগাজিন এক আর্টিকেলে দাবি করে, বার্ড বলেছিলেন,  “যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রস্তুত থাকা, কারণ যে কোনো সময় আমরা এমন কিছু প্রযুক্তির মুখোমুখি হতে পারি যা বাতাসে ঘণ্টায় ২০০০ মাইল বেগে চলতে সক্ষম।”

কেউ হাসে, কেউ ভয় পায়। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব জমে উঠতে থাকে। বই বের হয়, 'নাজি ইউএফওস', 'বেস ২১১',  'এলিয়েন্স ইন অ্যান্টার্কটিকা'—সব যেন এক বিন্দুতে এসে মেশে। অপারেশন হাইজাম্প ছিল নাৎসিদের শেষ ঘাঁটি ধ্বংসের মিশন, যেখানে তারা হেরে গিয়েছিল এমন শক্তির বিরুদ্ধে, যা মানুষের নয়।

সত্য-মিথ্যার সীমারেখা তখন বরফে ঢাকা। কেউ বলে এটা কেবল যুদ্ধপরবর্তী ভূখণ্ড দখলের কৌশল, কেউ বলে এটা ছিল মানবসভ্যতার প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ। তবে চূড়ান্ত সত্য এটাই যে অপারেশন হাইজাম্পের অনেক ফাইল আজও গোপন। আর তার চারপাশে জমে আছে বরফের মতো রহস্য, যা গললে হয়তো খুলে যাবে এক নতুন অধ্যায়, যা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গোপন যুদ্ধের।

mahmudnewaz939@gmail.com

সর্বশেষ খবর