নুহাশ হুমায়ুনের "ভাগ্য ভালো": মানু্ষ যেখানে শুষে নেয় মানুষের ভাগ্য
প্রকাশ :
সংশোধিত :
"পড়দা সরাইস না" সংলাপটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের হরর গল্পের ইতিহাসে মানুষ বহুদিন স্মরণে রাখবে। কীসের পড়দা? কে সরাবে? জানতে গেলে দেখতে হবে নুহাশ হূমায়ুনের হরর এন্থোলজি সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের দ্বিতীয় পর্ব "ভাগ্য ভালো।"
৩৭ মিনিটের এই পর্বের ভালো দিক অনেক, কেননা খারাপ দিক প্রায় নেই বললেই চলে। এতো অল্প সময়ের গল্পে যে গভীর একটা ধারণা তুলে আনা যায় এবং গল্পের বক্তব্য দর্শককে গল্পের ভিতরে ডুবিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না সেটা এই পর্বটি না দেখলে বোঝা যাবে না।
একজন জ্যোতিষীকে নিয়ে এই গল্প। যিনি তার মার সাথে লেক পাড়ের একটি বস্তিতে কষ্টের জীবন পার করে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে নিজের হাত নিজে দেখা বারণ। তবে এই কাজকে জ্যোতিষির গুরু নাম দিয়েছিলেন "পড়দা সরানো।" ঘটনাক্রমে এই কাজটি জ্যোতিষি করতে বাধ্য হয়।
ধীরে ধীরে গল্প যখন এগিয়ে যায় তখন কেন্ত্রীয় চরিত্র আর জ্যোতিষি থাকে না। তার জায়গায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে একটা ধারণা।
পুঁজিবাদ! এটা এমন এক ধারণা যার জন্ম মানুষের অন্যকে নিজের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণ করে শুন্য থেকে সমাজের শীর্ষে ওঠার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে। যে এই আকাঙ্ক্ষায় যত প্রবলভাবে অংশগ্রহণ করে তার কাছেই তার চারপাশের মানুষ ততো বোঝা হয়ে ওঠে।
তার কাছে মানবিক সম্পর্ক, অনূভুতি, সামাজিক বিধিনিষেধ, প্রকৃতির ভারষাম্য সবকিছুই একেকটা পর্দা আকারে উপস্থিত হয় যাকে তার সরিয়ে দিয়ে উপরে যেতে হবে।
পুঁজিবাদ মানুষের ভাগ্য তৈরি করে না অন্যের ভাগ্য শুষে নিতে বাধ্য করে। এই ব্যবস্থার এক দিকে ক্ষতি আরেকদিকে উন্নতি। যে কারণে এই গল্পে পুঁজিবাদ এক ধরনের শয়তানের জীবন পদ্ধতি আকারে উপস্থাপিত হয়েছে।
চিত্রনাট্য নিয়ে বলতে গেলে মা গুলতেকিন আর পূত্র নুহাশের কাজ একবারও দর্শককে গল্পের বিষয়বস্তু থেকে সরতে দিবে না। হুমায়ুন আহমেদের গল্পের এমন একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে একবারও মনে হতো না যে একটা বক্তব্য দেবার জন্য গল্প বলা হচ্ছে। মনে হতো গল্প বলতে বলতে বক্তব্য হাজির হচ্ছে।
নুহাশ হুমায়ূনের গল্প বলার ধরনে এর এক রকমের প্রভাব দেখা যায়। মোশাররফ করিমের অভিনয় আলাদা করে কিছু বলার নেই। পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে দুজনের কথা বলতে হবে তারা হলেন জ্যোতিষির মায়ের চরিত্রে জেবুন্নেছা সোবহান আর শয়তানের চরিত্রে স্বল্প সময়ের জন্য আফজাল হোসেন।
তানভির রিয়াদের ভিএফেক্স প্রশংসনীয়। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যের ঢাকার যে চিত্র তুলে ধরে সেই দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। ফুয়াদ সৌরভ এডিটিং এ গল্পের চাহিদা অনুসারে ডিজল্ভ আর জাম্প কাট ব্যবহারে ভুল করেননি।
প্রাচ্যের সঙ্গীত দিয়ে কীভাবে ভৌতিক অনুভতি তৈরি করা যায় তা দারুণভাবে দেখিয়েছেন অভিষেক ভট্টাচার্য।
নুহাশ হুমায়ূনের এই গল্প ঢাকার মতো একটি শহর যেখানে মানুষ সামন্তবাদী সমাজ থেকে সে কবেই পুঁজিবাদী সমাজে পরিণত হয়েছে তার বর্ণনা। এইচ পি লাভক্রাফটের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নুহাশ হুমায়ূন হরর কোনো কিছু না দেখিয়ে স্রেফ অদেখা জগতের বর্ণনা দিয়ে একটা সফল ভৌতিক গল্প বলতে সমর্থ হয়েছে। যেটা শুধু একটি গল্প হয়েই আর থাকেনি বরং, এক দ্রুত বর্ধনশীল সমাজের মানুষগুলো কেমনভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তার গভীর পর্যবেক্ষণ।