নিউ রাস মোহন বাসনালয়: শতবর্ষের ঐতিহ্য ধরে রাখা তামা-কাঁসার এক ভান্ডার

প্রকাশ :
সংশোধিত :

পুরান ঢাকা মানেই শুধু খাবারের গলি কিংবা সরু রাস্তার ভিড় নয়। এই শহরের অলিগলির ভাজে লুকিয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্প। সেই গল্পেরই এক জীবন্ত অংশ বাংলা বাজারের নিউ রাস মোহন বাসনালয়। শতবর্ষ পুরনো দোকান, যেখানে আজও টিকে আছে তামা-কাঁসা ও পিতলের জিনিসপত্র।
শতবর্ষী এই দোকান। প্রথমে রাস মোহন নামে পরিচিত এই বাসনালয়ের কর্মচারী ছিলেন জগন্নাথ সাহা। ভাগ্যের অদলবদলে মূল মালিক ভারতে চলে গেলে দোকানটি দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাছে। জগন্নাথ সাহা শুধু দায়িত্বই নেননি, বরং নিজের শ্রম, সততা আর ভালোবাসায় টিকিয়ে রেখেছেন দৃঢ় ভিত্তির ওপর। নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘নিউ’, আর সেই থেকে নতুন রূপে পরিচিতি পায় নিউ রাস মোহন বাসনালয়।
সময়ের পালাবদলে চারপাশের দৃশ্য পাল্টেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু দোকানটি রয়েগেছে আগের মতোই যেন। একসময় যখন তামা-কাঁসার বাসন ছাড়া সংসার কল্পনা করা যেত না, তখন এখান থেকেই অসংখ্য পরিবার ও সংসারের যাত্রা শুরু।
যা পাওয়া যায়
দোকানে ঢুকলেই চোখ ধাঁধিয়ে যাবে তামা-কাঁসা ও পিতলের সব তৈজসপত্রে। প্রায় পাঁচশত রকমের পণ্য পাওয়া যায় এখানে। থালা, বাটি, গ্লাস, জগ, হাড়ি-পাতিল,চামচ, খুন্তি থেকে শুরু করে সুন্দর সব শোপিস।
শুধু আধুনিক ব্যবহারের জিনিসই নয়, এখানেই মিলবে অতীতের স্মৃতি বহনকারী পণ্য যেমন, পিকদানি, বদনা, মটকা ও বড় বোর কলস, ল্যাম্প বা কুপি, কয়লার ইস্ত্রি, ঘন্টি বা বাজনা, তালা-চাবি, আকতাবি ও ড্যাক, মাটির মতো আকৃতির পুতুল। শুধু ব্যবহারিক নয় শৌখিন মানুষদের জন্য হাতে তৈরি নকশা করা শিল্পকর্মও সাজানো থাকে দোকানের তাকজুড়ে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলছে এই ব্যবসা
আজ বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন জগন্নাথ সাহা। তিনি আর নিয়মিত দোকানে বসতে পারেন না। তবে ব্যবসার হাল ধরেছেন তার ছেলে শুভ সাহা। ঢাকা শহরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি বাবার এই ব্যবসায় ঝুঁকেছেন। শুভ সাহা বলেন, “আমার বাবা মূলত এই ব্যবসা করতেন। এখন তিনি অসুস্থ থাকায় আমিই দোকান দেখি। আমাদের পণ্যগুলো আসে মূলত জামালপুরের ইসলামপুর থেকে। সেখানে আমাদের নিজস্ব কারিগর তামা-কাঁসার জিনিস তৈরি করে। এছাড়া ধামরাইয়ের শিমুলিয়া ও চাপাইনবাবগঞ্জেও এ ধরনের পণ্য বানানো হয়।”
বাজার ও ব্যবসার পরিবর্তন
আগে গ্রামীণ জীবনে তামা-কাঁসার জিনিস ছাড়া সংসার চলতো না। রান্না, পানি রাখা থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচার সবখানেই ছিল এর ব্যবহার। কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের চল শুরু হবার পর এসবের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে।
তবে শুভ সাহার মতে, নতুন প্রজন্মের আগ্রহ এবং অনলাইনের প্রসারে আবারও কিছুটা চাহিদা তৈরি হয়েছে। অনলাইন মাধ্যমেই দেশজুড়ে অনেকেই জানতে পারছেন পুরান ঢাকার এই শতবর্ষী দোকানের কথা।
উৎসবের সময়ে বাড়তি চাহিদা
বিশেষ করে হিন্দুধর্মের পূজা-পার্বণে তামা-কাঁসা-পিতলের পণ্যের ব্যবহার অপরিহার্য। তাই দুর্গাপূজা কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে বিক্রি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
ঐতিহ্যের সঙ্গে আবেগ
তামা-কাঁসা শুধু একটা ধাতু নয়। এটি আসলে বাঙালির আবেগ, উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। একসময় নতুন বউয়ের জন্য উপহার হিসেবে কিংবা সন্তানের জন্ম উপলক্ষে তামা-কাঁসার বাসন দেয়া হতো।
আজও অনেক পরিবারে পুরোনো কাঁসা বাটি বা জগ রয়েছে, যা দাদী-নানীর হাত থেকে এসেছে। নিউ রাস মোহন বাসনালয় ঠিক সেই স্মৃতিগুলোই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দেয়।
পুরান ঢাকার ইতিহাস শুধু স্থাপত্যই আবদ্ধ নয়। এর প্রতিটি আনাচে-কানাচে, দোকান, রেস্তোরাঁ কিংবা কোনও চওরাস্তা নানান ইতিহাসের সাক্ষী। নিউ রাস মোহন বাসনালয় সেই ইতিহাসের গর্বিত প্রতিনিধি।
sadmanshawon121@gmail.com
 
 
              For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.