চন্দ্রাবতী: প্রেম ও সাধনার জন্য সমাদৃত বাংলার প্রথম নারী কবি

বাঁ দিকে চন্দ্রাবতীর নির্মাণ করা শিবমন্দির ও ডান দিকে তার বাড়ি
বাঁ দিকে চন্দ্রাবতীর নির্মাণ করা শিবমন্দির ও ডান দিকে তার বাড়ি ছবি : ফাইজা জামান

প্রকাশ :

সংশোধিত :

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি কে- এ নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক থাকলেও ইতিহাসবীদরা মনে করেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। অসাধারণ সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি কথিত বেদনামধুর প্রেমকাহিনীর জন্যও ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন এই নারী।

চন্দ্রাবতীর জন্ম আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে, কিশোরগঞ্জ জেলার ফুলেশ্বরী নদীর তীরে পাতোয়াইর গ্রামে।

পিতা দ্বিজবংশী দাস ছিলেন মঙ্গলকাব্য রচয়িতা, আর মা সুলোচনা ছিলেন একজন গৃহিণী। চারণ কবি দ্বিজ বংশী দাস নিজেই গান রচনা করতেন এবং গ্রামে গ্রামে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন।

কবি পরিবারেই বেড়ে ওঠা চন্দ্রাবতীর সৃষ্টিশীলতা তাকে অমর করে রেখেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।

ষোড়শ শতাব্দীর অন্য অনেক কবিদের মতো চন্দ্রাবতীরও উত্থান মূলত গীতিকবিতার মধ্য দিয়ে। তিনি মূলত পালা গান ও কাব্য রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। 'চন্দ্রাবতীর রামায়ণ' তার সেরা কীর্তি হিসেবে ধরা হয়। এটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কোনও নারী রচিত মহাকাব্যও বলা হয়ে থাকে। এছাড়া, 'মলুয়া; ও 'দস্যু কেনারামের পালা' তার সাহিত্যভাণ্ডারের উজ্জ্বল নিদর্শন। নারী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মহাকাব্য রচনার সাহসী প্রয়াস তাকে আলাদা মর্যাদা এনে দিয়েছে।

প্রেমকাহিনির বেদনাময় অধ্যায়

চন্দ্রাবতী কেবল তার সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনও কৌতূহলোদ্দীপক। চন্দ্রাবতীর জীবন কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর সঙ্গে এক বেদনাবিধুর প্রেমও জড়িয়ে আছে।

কথিত আছে শৈশবের সঙ্গী অনাথ বালক জয়ানন্দকে ভালোবাসতেন চন্দ্রাবতী। এমনকি পরিবার তাদের বিয়ের ব্যবস্থাও করেছিল। কিন্তু বিবাহের দিনেই জয়ানন্দ ধর্ম পরিবর্তন করে আসমানী নামে এক মুসলমান কাজীর কন্যাকে বিয়ে করেন।

আবার অনেকে বলেন, প্রেমের প্রাপ্তিলগ্নে বিয়ের দিন-তারিখ নির্দিষ্ট হবার পর চন্দ্রাবতী জানতে পারেন জয়ানন্দ অপর এক মুসমান রমনীকে আগেই বিয়ে করেছে।

যে ঘটনাই সত্য হোক না কেন, প্রতারণার এই আঘাত চন্দ্রাবতীর জীবনে ঝড় বয়ে আনে। অনেকে মনে করেন তার এই হৃদয় ভঙ্গের বেদনা থেকে তিনি কখনোই বের হতে পারেননি।

ভালোবাসা না পাওয়ার বেদনায় জীবনে কখনও সংসারধর্মে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এজন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন এই কবি। আজীবন কুমারী থেকে শিবসাধনায় আত্মনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। একই সময়ে ‘রামায়ন’ রচনায় মনোনিবেশ করেন কবি।

পরে অনুতপ্ত জয়ানন্দ ক্ষমা চাইতে এলে চন্দ্রাবতী তাকে আর কখনও দেখা দেননি। এদিকে ভালোবাসা হারানোর কষ্টে এবং নিজে করা অন্যায়ের অনুতাপে জয়ানন্দ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চন্দ্রাবতীও শোকে নিঃশেষ হয়ে যান। এর ফলে, অসমাপ্ত রয়ে যায় তার ‘রামায়ন’ রচনা।

বাড়ি ও শিবমন্দির

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। মূল শহর থেকে মাত্র ৫-৬ কিলোমিটার দূরের এ স্থানটিতে রয়েছে তার নির্মিত দুটি শিবমন্দির।

পোড়ামাটির কারুকাজে সমৃদ্ধ এই স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে একটি মন্দির প্রায় ৩২ ফুট উঁচু। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে মন্দিরটির সংস্কার করলেও কবির বাড়ি আজ ধ্বংসপ্রায়। ভাঙাচোরা মেঝে, ভগ্ন দেয়াল আর জীর্ণ দরজায় ইতিহাসের আক্ষেপই ধরা দেয়। বর্তমানে সেখানে একটি হিন্দু ও একটি মুসলমান পরিবার বসবাস করছে।

সময়ের আঘাতে এই নির্দশন অনেকখানি জৌলুশ হারিয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি চন্দ্রাবতী মন্দির বাদেও তার নামে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

পৌঁছাবেন যেভাবে

চন্দ্রাবতীর আবাসভূমি দেখতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে কিশোরগঞ্জ শহরে। পুরানথানা এলাকার শহীদি মসজিদের সামনে থেকে অটোরিকশা ভাড়া করে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যায় কবির বাড়িতে। পথের বাঁক, গ্রামীণ প্রকৃতির শোভা আর ফুলেশ্বরীর তীরের নীরবতা মিলিয়ে এটি এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনি যেন একইসাথে সাহিত্য, প্রেম, বেদনা আর ভক্তির চিত্রপট। তার ধ্বংসপ্রায় বাড়ি, শিবমন্দির ও ফুলেশ্বরীর তীর এখনও মনে করিয়ে দেয় সেই নারী কবির সংগ্রাম, অভিমান আর অমর সৃষ্টিকে। বাংলার প্রথম নারী কবি হিসেবে তিনি শুধু ইতিহাসে নন, মানুষের হৃদয়েও বেঁচে আছেন চিরকাল।

faizazaman0403@gmail.com

সর্বশেষ খবর