অর্থনীতির মন্দাবস্থার ঝুঁকি

রিপোর্ট

প্রকাশ :

সংশোধিত :

যেহেতু বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হচ্ছে না এবং সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হারও সন্তোষজনক নয়, তাই দেশের অর্থনীতি যে মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এটা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ স্বয়ং এই মন্দাবস্থার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হতে বলেছেন। তিনি এই মন্দাবস্থার কারণগুলোও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এবং সরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয়ে স্থবিরতা আসায় দেশের অর্থনীতি মন্দাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে এবং উত্তরণ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব না যতক্ষণ এই দুই খাত ঘুরে দাঁড়াবে।” সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ দেশের উন্নয়ন খাত নিয়ে তাদের করা একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিগত ১৪ বছরের মধ্যে এবারই জুলাই-অক্টোবরে উন্নয়ন প্রকল্পে সবচেয়ে কম অর্থ ব্যয় করেছে। মূলত তাদের এই প্রতিবেদন পরিকল্পনা উপদেষ্টার শঙ্কার কথাই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, উচ্চ ঋণ এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা বিনিয়োগ খাতকে সংকুচিত করছে। দেশে প্রয়োজনের তুলনায়  বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবাহ কম হওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যদি আমাদের দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরো দমে উৎপাদনকাজ চালাতেও পারতো তার পরেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হতো। কেননা দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, যার জন্য দেশের বাজারে শিল্পপণ্যের চাহিদা কমেছে। বিশেষ করে যেসকল প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে পণ্য রপ্তানি করে না, তাদের অবস্থা আরো নাজুক।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নতুন বিনিয়োগ। তবে দেশীয় বা বৈদেশিক বিনিয়োগ যেটাই হোক না কেন তার জন্য আগে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবস্থায় যে ত্রুটিগুলো রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথমে সেগুলো সংস্কার করতে হবে। এরপর দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। বিগত সরকারের শাসনামলে যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলো পুনর্মূল্যায়নের জন্য তিনমাস খুবই স্বল্প সময়। ওই সরকার যে প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছিল সেগুলোর সবই যে বাস্তবায়ন হয়েছে এমনটিও নয়; আবার কিছু কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এগুলো নিয়ে তেমন বিতর্কও নেই। কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এগুলোর ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করে অগ্রাধিকারভিত্তিকে দেশের উন্নয়নের খাতে সেটা ব্যবহার করছে না?

বর্তমাতে চলমান প্রকল্পগুলো যাতে চলমান থাকে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন। তিনি এগুলো বাস্তবায়নের জন্য ‘নীতি সমন্বয়ের’ উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি নতুন নির্দেশনা জারি হয়েছে, যা এই অর্থবছরের মধ্যে চলমান প্রজেক্টগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা একটি ডিও লেটার বা আধাসরকারি পত্র প্রেরণের মাধ্যমে বিভিন্ন মত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের অনুরোধ করবেন তারা যেন তাদের মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়।

যাইহোক সময় দ্রুত এগোচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখন যদি সবকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি দ্রুতগতিতে এগোয়, তাহলে হয়তো মন্দাবস্থা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। আর বর্তমান অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে এই স্বল্পকালীন পরিকল্পনার কোনো বিকল্পও নেই। আমাদের পরিকল্পনা উপদেষ্টা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে, বিশেষ করে শিক্ষাসামগ্রী ও গবেষণাসামগ্রী ক্রয়ে, বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই খাতগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধিও সংকট উত্তরণে কমই ভূমিকা রাখবে।

এখন যেটি সবচেয়ে কার্যকর সেটি হলো নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং ব্যাপক সংখ্যাক মানুষকে সেগুলোতে নিয়োজিত করা। তাহলে দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষের আয়ের পথ সৃষ্টি হবে, যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আর দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে, দেশীয় পণ্যের চাহিদাও বাড়বে। ফলে দেশের অর্থনীতিতেও স্থিতিশীলতা আসবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য রপ্তানি বৃদ্ধি তেমন কার্যকর সমাধান নয়। কেননা এটা শুধু রপ্তানিকারকদের ধনী করবে এবং সরকারের রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করবে। যাইহোক, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে না পারলে একটা অসমতা তৈরী হবে।  

সর্বশেষ খবর