অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য মজুরি কাঠামো
প্রকাশ :
সংশোধিত :
কোনো নির্দিষ্ট কাজ বা পরিসেবার বিনিময়ে নূন্যতম মজুরি প্রাপ্তি যেকোনো শ্রমিকের জন্য একটি আইনগত অধিকার। একটি শিল্প-কারখানার মূল চালিকাশক্তি হলো শ্রমিকেরা। তাদের ব্যতীত উৎপাদনকার্য চলমান রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরির অধিকার কমবেশি সবদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলোও তাদের কার্যপ্রণালীতে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন কাঠামো তথা নূন্যতম মজুরি প্রাপ্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও শ্রমিকদের মার্জিত বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে পারেনি।
সঠিক বেতন কাঠামো না থাকায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য ভাতা মালিকপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে এবং বাজার পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য না রেখেই মজুরি নির্ধারণ করে। মালিকপক্ষ প্রণীত বেতন ও অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানসম্মত কোনো নীতি অনুসরণ করা হয় না। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের অবসরকালীন ভাতাও সঠিকভাবে প্রদান করা হয় না।
আমাদের বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য প্রণীত বেতন কাঠামোতে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের ঐক্যমত থাকে না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ শ্রমিকপক্ষের দাবিকে উপেক্ষা করে। সেকারেণ আমাদের দেশে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই থাকে। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা মাঝেমধ্যেই তাদের প্রাপ্য বেতন, ওভারটাইম মজুরি ও অন্যান্য ভাতার দাবিতে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে ঘন ঘন শ্রমিক ধর্মঘট সার্বিক উৎপাদনকার্য ও মালিক-শ্রমিক উভয়ের জন্যই বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করে। আর এর ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আন্তর্জাতিক মানসম্মত নূন্যতম মজুরি কাঠামো দেশের শিল্পাঙ্গনে উদ্ভুত সংকট কাটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
সংকট কাটাতে, সরকার ইতিমধ্যে দেশের ১৫টি বেসরকারি শিল্পখাতে কর্মরত শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় নূন্যতম বেতন কাঠামো প্রণয়নে উদ্যোগী হয়েছে। এরই মধ্যে ৪টি খাতের জন্য আলাদা ওয়েজবোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং তারা শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি নির্ধারণে কাজ করে যাচ্ছে। শ্রম মন্ত্রাণালয়ের বরাত দিয়ে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় বাংলাদেশে একই খাতে শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরিতে ভিন্নতা থাকে। নূন্যতম মজুরি কাঠামোর অনুপস্থিতি ও বেতন প্রদানে মালিকপক্ষের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকায় বাংলাদেশের শ্রমখাতে সংঘাত-সহিংসতা বিরাজ করে। নূন্যতম মজুরি কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা বেতন সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আশা করা যায়, আসছে মজুরি কাঠামোতে দেশের শ্রমখাতে বিদ্যমান সংকটের সমাধান নিশ্চিত হবে। কেননা এটি বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হবে, যেখানে বাজার পরিস্থিতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। পাশাপাশি, আসছে মজুরি কাঠামোতে বাজার পরিস্থিতি নিয়মিত হালনাগাদ করা এবং সেই অনুযায়ী বেতন সম্প্রসারণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। যাইহোক, শুধুমাত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ই নয়, বরং এটি সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা তাও সরকারকে তদারকি করতে হবে। কর্তৃপক্ষকেও সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে করে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর জন্য প্রণীত মজুরি বিধান কারো অয়াচিত হস্তক্ষেপে ব্যাহত না হয়। এটা ভুলে গেলে চলবে না,সবকিছুর মূলে রয়েছে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শিল্পখাতকে একটা অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা।