বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে, ব্যবসা কার্যক্রমে বড় ধরণের মন্দার ইঙ্গিত

প্রকাশ :

সংশোধিত :

বেসরকারি খাতে আনুষ্ঠানিক ঋণ প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে। এতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রমে গভীর মন্দার সংকেত স্পষ্ট হয়েছে।

ঋণ প্রবৃদ্ধির এই পতনের পেছনে রয়েছে ব্যাংকগুলোর বাড়তি সতর্কতা এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণে অনীহা। ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের (এনপিএল) ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির কারণে রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করেছে, আর উদ্যোক্তারা একাধিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঋণের উচ্চ সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অন্যতম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে প্রাপ্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির রেকর্ড এত নিচে কখনও নামেনি এই হার— এমনকি পূর্বের আর্থিক সংকটকালেও নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের ১৬ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।

গত বছরের আগস্ট থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি (কনট্রাকশনারি মানিটারি পলিসি) অব্যাহত রেখেছে এবং ব্যবসায়ীদের সমালোচনার পরেও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে নীতিগত সুদহার ১০ শতাংশে স্থির রাখছে।

তিনি বলেন, “ঋণের উচ্চ সুদহার, জ্বালানি সংকট, শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তার ঘাটতি এবং নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য সহিংসতা—এই কারণগুলোই ঋণ চাহিদা তীব্রভাবে কমিয়ে দিয়েছে।”

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (ডিসেম্বর পর্যন্ত) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ, তবে বর্তমান প্রবৃদ্ধি সেই লক্ষ্য থেকে নিচে রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে আমদানি আদেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় ঋণ প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার হতে পারে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পরভেজ) বলেন, “জ্বালানি সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদন বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “ডলারের বিপরীতে টাকার তীব্র অবমূল্যায়ন ব্যবসা পরিচালনায় বড় বাধা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে ঋণের উচ্চ সুদহার যেন শেষ আঘাত হিসেবে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগ করবে কে? উদ্যোক্তাদের জন্য বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-কে বলেন, “অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেসরকারি খাত থেকে ঋণের চাহিদা অব্যাহতভাবে কমছে।”

তিনি আরও জানান, বছরের শেষ প্রান্তিকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে সতর্ক আচরণ করছে, যাতে তাদের আর্থিক ভারসাম্য বজায় থাকে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির এই নিম্নগতি অর্থনীতির জন্য একটি নেতিবাচক সংকেত, যা বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান—সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারে।

এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “বর্তমানে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি খুবই ধীর—চলমান প্রকল্প এবং সম্প্রসারণ উভয় ক্ষেত্রেই। শিল্পকারখানাগুলো জ্বালানি সংকট, বিনিময় হারজনিত ঝুঁকি ও ঋণের উচ্চ সুদের কারণে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাতে পারছে না। ফলে উদ্যোক্তারা এখন ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত।” 

jubairfe1980@gmail.com

সর্বশেষ খবর