রেপো ঋণ নিয়ে লাভজনক ট্রেজারিতে বিনিয়োগ
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের মাত্রা রেকর্ড উচ্চতায়

প্রকাশ :
সংশোধিত :

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ দ্বৈত উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দেয়—ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্য সংকট নিরসনের পাশাপাশি এই তহবিল লাভজনক সরকারি ট্রেজারি বিনিয়োগে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ব্যাংকার ও অর্থ বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আমানত প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ায় এবং ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূলত তারল্যের ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুবিধার ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে অর্থবছরের শুরুতেই দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপো সুবিধার আওতায় মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি
টাকা ঋণ নিয়েছে।
এই টাকার মধ্যে ১৪ দিনের মেয়াদে ৭২ শতাংশের বেশি বা ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, ৭ দিনের মেয়াদে ৩৬ হাজার কোটি টাঁকা এবং ওভারনাইট সুবিধায় ৭ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুবিধার আওতায় তারল্য সহায়তার এই ঋণের পরিমাণ গত মার্চ, এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে ছিল যথাক্রমে ৮৩ হাজার ৮০০ কোটি, ৯৪ হাজার কোটি, ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি এবং ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সংক্ষিপ্তমেয়াদি তারল্য প্রয়োজন হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১৪ দিনের রেপো সুবিধার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে এবং এই এর মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ব্যাংকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বারবার এই স্বল্পমেয়াদি ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে, যাতে তারা চলমান মন্দা অর্থনৈতিক পরিবেশে লাভবান হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, রেপো-ভিত্তিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা থেকে বোঝা যায় যে বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক বর্তমানে চরম তারল্য সংকটে রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক ঋণ-সংক্রান্ত অনিয়ম প্রকাশ পাওয়ার পর ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আমানত প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।
অন্যদিকে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা (প্রায় এক-চতুর্থাংশ) এখন খেলাপি।
এই পরিস্থিতিতে, ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিক ঋণের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো সুবিধার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যেখানে তিন বছর আগে তা ছিল ১২ শতাংশের বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান জানান, ব্যাংকগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি তারল্য সুবিধা ব্যবহার করে নগদ সংরক্ষণ অনুপাতে (সিআরআর) অর্থ জমা রাখে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায়ই এই ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে যাতে চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে বেশি লাভ অর্জন করতে পারে।
তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ৪ শতাংশ নগদ সংরক্ষণ করতে হয়, যা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার সমান।
তিনি বলেন, “কিন্তু গত জুলাই মাসে ব্যাংকগুলো ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এটি দেখায় যে ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ তারল্য সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কয়েক সপ্তাহের জন্য রেপো সুবিধা বন্ধ করে দেয়, তাহলে অধিকাংশ ব্যাংক ধসে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিতে, আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ঋণের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো সুবিধা কমিয়ে দিচ্ছে, যা "দুর্ভাগ্যজনক"।
রোজকার লেনদেন থেকে কমিয়ে এখন সপ্তাহে একবার রেপো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২৮ দিনের রেপো সুবিধা ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ১৪ দিনের সুবিধাও তুলে দেওয়া হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশ হারে রেপো সুবিধা গ্রহণ করে তা সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে ১০ শতাংশের বেশি হারে আয় করছে, যা একটি আরবিট্রাজ সুযোগ তৈরি করেছে।
তিনি দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-কে বলেন, “এইভাবে, ব্যাংকগুলো চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ করে চলেছে।”
তিনি আরও বলেন, আমানত বৃদ্ধির জন্য আস্থা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সরবরাহ পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে যাতে ব্যাংকগুলো তাদের সম্পদ উৎপাদনমুখী খাতে সরাতে উৎসাহ পায়।
jubairfe1980@gmail.com

