২০ বছরে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন: বড় মন্ত্রণালয়গুলোর চরম ব্যর্থতা

প্রকাশ :

সংশোধিত :

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয় সর্বনিম্নে পৌঁছেছে, কারণ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা কমিয়ে আনা ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে ছিল।

সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকাশিত তথ্যানুসারে, সংশোধিত ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি’র মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা বা ৬৭.৮৫ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থাগুলো।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এর আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০.৬৩ শতাংশ। ফলে এবার বাস্তবায়নের হার কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর থেকে এটি ছিল সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের হার। সরকার এর আগের কোনো অর্থবছরের উন্মুক্ত তথ্য সংরক্ষণ করেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নজিরবিহীন ধীরগতির পেছনে রয়েছে নানা জটিলতা— আমলাতান্ত্রিক বাধা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে নতুন প্রকল্প অনুমোদনে সতর্কতা, এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রকল্প বাস্তবায়নে উদাসীনতা।

আইএমইডি’র কর্মকর্তারা দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–কে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা’ই ছিল সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের প্রধান কারণ। কারণ এই মন্ত্রণালয় তাদের বরাদ্দ ৫,৬৭৩ কোটি টাকার মাত্র ২১.৭৪ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে গত অর্থবছরে।

তারা আরও বলেন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ কিছু সংস্থার ব্যয়হার গড় ৬৭.৮৫ শতাংশেরও নিচে ছিল।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর আর্থিক নীতিই ছিল এডিপি বাস্তবায়নের এই রেকর্ড পতনের অন্যতম কারণ।

তবে, সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর ভালো পারফরম্যান্স না থাকলে বাস্তবায়নের হার আরও নিচে নামত বলেও মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের সংস্থাগুলো তাদের ১০ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার বরাদ্দের ৯৩.২১ শতাংশ ব্যয় করেছে।

অন্যদিকে, সরকারি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো এডিপির প্রকল্প সাহায্যভিত্তিক অংশে ধীরগতি দেখিয়েছে; তারা সেখানে মাত্র ৬৫.৫৩ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে।

তবে সরকারি অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ব্যয়ের হার কিছুটা বেশি ছিল— ৬৭.৩৩ শতাংশ, যা বিদেশি সাহায্যভিত্তিক ব্যয়ের তুলনায় বেশি।

শীর্ষ ১৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাস্থ্য, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার গড়ের চেয়ে কম ছিল।

অন্যদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ যথাক্রমে ৯৮.১০ শতাংশ ও ৯০ শতাংশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেরা পারফর্ম করেছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এর পেছনে একাধিক কারণ তুলে ধরেছেন— জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, জটিল কেনাকাটার প্রক্রিয়া, এবং বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্পে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি বারবার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে।

তারা বলেন, "সরকারের আর্থিক ভারসাম্য রক্ষা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ কিছুটা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কড়াকড়ি বাড়িয়েছে, যার ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি হ্রাস পেয়েছে।"

এত কম বাস্তবায়নের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ও জনসেবা উন্নয়নের জন্য জরুরি অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো আরও বিলম্বের মুখে পড়বে।

এর ফলে কর্মসংস্থান, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, এবং জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথও বাধাগ্রস্ত হবে। বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যবহার করতে না পারা মানে অর্থনীতিকে চাঙা করার সম্ভাবনা হাতছাড়া হওয়া, বিশেষ করে বৈশ্বিক প্রতিকূলতার সময়ে যখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো জরুরি।

অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা ভবিষ্যতের জন্য এডিপি বাস্তবায়ন কাঠামোর একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস –কে দেওয়া এক মন্তব্যে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "গত এক বছরে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রাজপথে বিভিন্ন আন্দোলনের সম্মুখীন হয়েছে, যা কম এডিপি বাস্তবায়নের একটি বড় কারণ।"

তিনি আরও বলেন, "সরকারের সংযত ব্যয় নীতি ও চলমান প্রকল্পগুলো কঠোরভাবে পর্যালোচনার প্রভাবও প্রকল্প বাস্তবায়নের হারে পড়েছে।"

তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সহ বড় বাজেটধারী কিছু মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে তাদের উন্নয়ন বাজেট ব্যয়ের সক্ষমতা আরও কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।

kabirhumayan10@gmail.com 

সর্বশেষ খবর